বিআরটিসির বাসেও অর্ধেক ভাড়া পুরো কার্যকর হয়নি

ঢাকার বাইরে বিআরটিসির বাসেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। কোনো কোনো জেলায় সরকারি এ সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, অর্ধেক ভাড়া আদায়ের বিষয়ে তাঁরা এখনো সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা পাননি।

দুজনের ভাড়া ১৫ টাকা দিতে চাইলাম। কিন্তু একজনের অর্ধেক ভাড়া ৫ টাকা নেবে না। চালকের সহকারী বলছিলেন, সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। তাই ১০ টাকার নিচে অর্ধেক ভাড়া নেই।
আবদুর রশিদ, শিক্ষার্থীর অভিভাবক

অন্যদিকে রাজধানীর বেসরকারি মালিকানার সব বাসেও শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ভাড়া কিছুটা কম রাখা হলেও তা অর্ধেকের চেয়ে বেশি। ১০ টাকার নিচে ভাড়াও নিতে চাচ্ছেন না বাসচালকের সহকারীরা। তাঁদের যুক্তি, ঢাকা শহরে সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ৮-১০ টাকা।

দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে সারা দেশে বিআরটিসির বাসে এবং পরে বেসরকারি পরিবহনমালিকেরা রাজধানী ঢাকায় শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার ঘোষণা দেন। গত বুধবার এই ঘোষণা কার্যকর করা হয়। যদিও শিক্ষার্থীদের দাবি, সারা দেশে বাসে অর্ধেক ভাড়া কার্যকর করতে হবে। গতকালও তাঁরা রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বিক্ষোভ করেন। তাঁরা সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অর্ধেক ভাড়া কার্যকরের বিষয়টি আনুষ্ঠানিক প্রকাশের দাবি করেন।

বিষয়টি বিআরটিসি বাস ডিপোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক পরিদর্শক মশিউর রহমানকে জানালে তিনি নির্দেশনার একটি চিঠি নিয়ে কাউন্টারে আসেন। তিনি জানতে চান, কেন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পুরো ভাড়া নেওয়া হচ্ছে? কাউন্টারের কর্মী সিকান্দার বলেন, ‘স্যার, আমরা তো চিঠি পাইনি।’ পরে সিকান্দারের হাতে চিঠিটি ধরিয়ে দেন পরিদর্শক মশিউর।

ঢাকার বাইরে বিআরটিসি বাস

বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর ও বরিশাল জেলায় গতকাল বিআরটিসির বাসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়ের চিত্র ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা।

বগুড়া বিআরটিসি বাস ডিপো সূত্রে জানা গেছে, এই ডিপো থেকে উত্তরবঙ্গ ছাড়াও পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন পথে বর্তমানে প্রতিদিন ৩১টি বাস চলাচল করে।

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বগুড়া ডিপোতে দেখা গেছে, কাউন্টারে অর্ধেক ভাড়ার নোটিশ টাঙানোর কথা থাকলেও তা নেই। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পুরো ভাড়াই আদায় করা হচ্ছে।

বগুড়ার সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী সিরাজুম মনিরা। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে জয়পুরহাটের কালাই সদরে যাওয়ার জন্য বিআরটিসির কাউন্টারে আসেন। সঙ্গে তাঁর মা ছিলেন। কাউন্টার মাস্টার দুজনের ১২০ টাকার টিকিট দেন। সিরাজুম মনিরা বলেন, শিক্ষার্থীর ভাড়া তো অর্ধেক নেওয়ার কথা, কিন্তু তা নেওয়া হচ্ছে না।

টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া আদায়ের কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।

একই চিত্র দেখা গেছে রাজশাহীতে। বিআরটিসির কাউন্টার থেকে শিক্ষার্থীদের বলা হয়, অর্ধেক ভাড়ার বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন বা চিঠি না পাওয়ায় তাঁরা এটা কার্যকর করতে পারছে না।

রংপুর শহরের হাজিপাড়া এলাকায় বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন পথে বিআরটিসির বাসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পুরো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। রংপুর হয়ে ঠাকুরগাঁওগামী বাসের যাত্রী এক শিক্ষার্থী বলেন, তিনি রংপুরে মেসে থেকে পড়াশোনা করেন। রংপুর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের ভাড়া নেওয়া হলো ১৮০ টাকা। ভাড়া বাড়ানোর আগে ছিল ১৪০ টাকা। এমনিতেই ৪০ টাকা ভাড়া বেড়েছে।

রংপুরে বিআরটিসির বাস কাউন্টারে টিকিট বুকিং মাস্টার নূরুন্নবী বলেন, শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার বিষয়ে কোনো নির্দেশ তাঁদের কাছে আসেনি। তাই অর্ধেক ভাড়া নেওয়া যাচ্ছে না।

গণপরিবহনে হাফ পাসের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

অবশ্য বিআরটিসির বগুড়া বাস ডিপোর ইউনিট প্রধান মো. মনিরুজ্জামান বলেন, তাঁরা সব জায়গায় চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটা কার্যকর হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য আজ (গতকাল) সন্ধ্যার মধ্যে বিভিন্ন কাউন্টার পরিদর্শন করবেন।

বরিশাল নগরের নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের পাশে বিআরটিসির বাস ডিপোতে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার কোনো ঘোষণা টাঙানো হয়নি। কাউন্টারে দায়িত্বরত কর্মী সিকান্দার আলী বলেন, এখনো অর্ধেক ভাড়ার কোনো নির্দেশনা বা চিঠি তাঁরা পাননি।

বিষয়টি বিআরটিসি বাস ডিপোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক পরিদর্শক মশিউর রহমানকে জানালে তিনি নির্দেশনার একটি চিঠি নিয়ে কাউন্টারে আসেন। তিনি জানতে চান, কেন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পুরো ভাড়া নেওয়া হচ্ছে? কাউন্টারের কর্মী সিকান্দার বলেন, ‘স্যার, আমরা তো চিঠি পাইনি।’ পরে সিকান্দারের হাতে চিঠিটি ধরিয়ে দেন পরিদর্শক মশিউর।

অর্ধেক ভাড়া দিতে পরিচয়পত্রের ফটোকপি

সিলেটে বিআরটিসির বাসে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার জন্য পরিচয়পত্রের ‘ফটোকপি’ কাউন্টারে জমা দিতে হচ্ছে। টিকিট বিক্রেতা নিয়াজ ওয়াসিফ বলেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী সাদাপাথর যাওয়ার জন্য অর্ধেক ভাড়ায় টিকিট নিতে আসেন। কিন্তু টিকিটে অর্ধেক ভাড়ার কোনো নির্দেশনা নেই। টিকিট বিক্রির টাকা জমা দেওয়ার সময় ঝামেলা হতে পারে ভেবে শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিতে বলা হয়েছে। পরে শিক্ষার্থীরা পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিয়ে অর্ধেক ভাড়ায় গন্তব্যে রওনা দেন।

সিলেট বিআরটিসির ডিপো ব্যবস্থাপক মো. জুলফিকার আলী বলেন, অর্ধেক ভাড়ার বিষয়টি স্টিকার আকারে তৈরি করে কাউন্টার এবং বাসে লাগানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আপাতত প্রাথমিক অবস্থায় কিছু সমস্যা হতে পারে।

গত ২৬ নভেম্বর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, ১ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে বিআরটিসির বাসে শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারবেন। শিগগিরই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এখনো মাঠপর্যায়ে এটা কার্যকর হতে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে বিআরটিসির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে কোথাও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না—গতকাল পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য তাঁদের কাছে নেই। সংস্থার সব স্তরে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার নির্দেশনা পৌঁছে গেছে। কর্মকর্তারাও তদারক করছেন। এরপরও কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

হাফ পাশ নেই—লেখা মুছে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা

ঢাকায় ১০ টাকার নিচে ভাড়া নেই

গতকাল প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদক রাজধানীর বিভিন্ন পথে চলাচলকারী আটটি বাসে চড়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া আদায়ের পরিস্থিতি দেখেন। দেখা যায়, সিটিং সার্ভিসের বাসে ‘চেকার’ উঠলে শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেখছেন। বাসে কতজন শিক্ষার্থী রয়েছেন, তা যাত্রীর সংখ্যা তালিকা ‘ওয়ে বিলে’ লিখে দিচ্ছেন। অন্যদিকে লোকাল বাসগুলোতে চালকের সহকারীরা অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেখে নিচ্ছেন।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে অভিভাবকদের সঙ্গে একদল পরীক্ষার্থী ঠিকানা পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। অধিকাংশ পরীক্ষার্থী নেমে যান সায়েন্স ল্যাব-সিটি কলেজ এলাকায়। কলেজের পোশাক পরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয় ১০ টাকা৷

আবদুর রশিদ নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘দুজনের ভাড়া ১৫ টাকা দিতে চাইলাম। কিন্তু একজনের অর্ধেক ভাড়া ৫ টাকা নেবে না।’ চালকের সহকারী বলছিলেন, সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। তাই ১০ টাকার নিচে অর্ধেক ভাড়া নেই।

ট্রান্স সিলভা পরিবহনের বাসে কলেজগেট থেকে সায়েন্স ল্যাবের ভাড়া ১০ টাকা। শিক্ষার্থীদের ভাড়া ৫ টাকা হওয়ার কথা। রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের এক শিক্ষার্থী ৫ টাকা দিতে চাইলেও চালকের সহকারী তা নিতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘৫ টাকা কোনো ভাড়া নেই। অর্ধেক ভাড়াও সর্বনিম্ন ১০ টাকাই। ১০ টাকার ভাড়াও অর্ধেক নিতে হলে মালিককে গাড়ি বেঁচে দেওয়া লাগব।’ রাজধানীতে চলাচলকারী বিআরটিসির কয়েকটি বাসেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ১০ টাকা ভাড়া আদায় করতে দেখা যায়।