ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুস সালাম বায়ুদূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার কাজ করছেন। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষ স্থানে বাংলাদেশের উঠে আসার বিষয়ে দূষণের কারণ ও এর প্রভাব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।
প্রথম আলো: বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। এর আগের বছরও বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল। বারবার এই ঘটনা কেন ঘটছে?
অধ্যাপক আবদুস সালাম: কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় প্রথম দিকে বাংলাদেশের নাম থাকছে। আর রাজধানী ঢাকা থাকছে শীর্ষ দূষিত নগরীর তালিকায়। এটা খুব দুঃখজনক একটি বিষয়। এখানে বায়ুর মান খারাপের ফলে জনস্বাস্থ্য যে চরম ক্ষতির মুখে, তা বলা বাহুল্য। এমনই আরেক নেতিবাচক দিক হলো, দেশের ভাবমূর্তি। সারা বিশ্বের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল এ দেশ হচ্ছে বন্যা, দারিদ্র্যকবলিত দেশ। কিন্তু গত কয়েক দশকে তৈরি পোশাকসহ শিল্পের নানা খাতে এবং সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশ আশাতীত উন্নতি করেছে। এতে দেশের সুনাম বেড়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর যদি দূষণের মাত্রা বাড়তেই থাকে, তাহলে উন্নতি ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। এতে অন্য দেশের মানুষ আমাদের এখানে আসতে নিরুৎসাহিত হবে। দেশে বিনিয়োগ কমবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। তাই বায়ুদূষণকে নিছক পরিবেশগত ইস্যু হিসেবে দেখলে হবে না। এর সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সরাসরি সম্পর্ক আছে।
প্রথম আলো: বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫–এর মাত্রা গত বছর ছিল ৭৬.৯। আগের বছর ছিল ৮৩.৩। কিছু উন্নতি কি লক্ষ করা গেল?
অধ্যাপক আবদুস সালাম: এটা মোটেও উন্নতির কোনো লক্ষণ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নতুন মানদণ্ড অনুযায়ী, পিএমের মাত্রা ৫ হলে তা ক্ষতিকর নয় বলে বিবেচনা করা হয়। আগে আরও বেশি ছিল, কিন্তু এখন ৫ করা হয়েছে। যেভাবে এই মান নির্ণয় করা হয়, তা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। কিন্তু তা যদি মেনেও নিই তাহলে এবার যে প্রায় ৭৭ হয়েছে, তা মানদণ্ডের চেয়ে ১৫ গুণের বেশি। তাহলে উন্নতি কোথায়। কয়েক বছর ধরে ৭০ থেকে ৯০–এর মধ্যে এটি ঘোরাফেরা করেছে। আমাদের উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই।
প্রথম আলো: এবার রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে নানামুখী উদ্যোগের কথা শোনা যায়। তাহলে সেগুলো কি ব্যর্থ হচ্ছে?
অধ্যাপক আবদুস সালাম: কোনো কার্যকর উদ্যোগ কি আদৌ আছে, আমার তো চোখে পড়ে না। এ নিয়ে নানা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার কথা শুনি। দিবস এলে এ নিয়ে বেশি কথা হয়। কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্যোগ তো দেখি না।
প্রথম আলো: পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটাগুলো ৫৮ ভাগ দায়ী। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারি সংস্থাগুলোর অবস্থানকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
অধ্যাপক আবদুস সালাম: ইটভাটাগুলো এতটা দায়ী বলে অধিদপ্তর যেভাবে বলে, এর সঙ্গে একমত নই। ঢাকার দূষণের প্রধান কারণ হলো নির্মাণকাজের সময় সৃষ্ট দূষণ। রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর নির্মাণের সময় সৃষ্ট ধুলাবালু বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়েছে। মেট্রোরেলের নির্মাণের সময় দূষণের পরিমাণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু এখন ৩০০ ফিট এবং যাত্রাবাড়ীর দিকে বড় যে রাস্তা হচ্ছে, সেগুলোর দূষণ অনিয়ন্ত্রিত। এ ছাড়া আছে যানবাহনের দূষণ। যানজট এ দূষণ আরও বাড়িয়ে তোলে। রাজধানীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার হাল করুন। সেটা দূষণের একটি বড় কারণ। বেশির ভাগ বর্জ্য উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকে। নির্মাণকাজের সময় সৃষ্ট ধুলার মধ্যে বড় কণাগুলোর চেয়ে ক্ষুদ্র কণা অনেক বেশি ক্ষতিকর। এই ক্ষুদ্র কণার মধ্যে সিলিকন একটি বড় অংশ। এর সঙ্গে যানবাহনের দূষিত পদার্থগুলো মিলে রাসায়নিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিকর দ্রব্য তৈরি হচ্ছে। এটি শুধু শিশু স্বাস্থ্য নয়, যেকোনো বয়সী মানুষের জন্য ভয়াবহ শারীরিক সমস্যা তৈরি করছে। আমাদের যেসব অসুখ এখন হচ্ছে, এর মধ্যে শ্বাসনালির অসুখ বেশি। বায়ুদূষণের কারণে এসব হচ্ছে।
প্রথম আলো: অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করার সময় দূষণের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেগুলো বাংলাদেশ কতটুকু কার্যকর?
অধ্যাপক আবদুস সালাম: নির্মাণকাজের সময় সবচেয়ে উপেক্ষিত বিষয় হলো দূষণ। এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আইন থাকলেও সেগুলো কার্যকর হয় না।
প্রথম আলো: দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অধ্যাপক আবদুস সালাম: তারা বায়ু, পানিসহ পরিবেশগত নানা দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাদের খুব কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখি না। তাদের লোকবলের সংকট আছে, সেটা বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু তারপরও যতটুকু কাজ তাদের করার কথা, তা হয় না।
প্রথম আলো: দূষণকারীর ক্ষতিপূরণ বলে একটা কথা আছে। আমাদের এখানে দূষণকারী কতটুকু সাজা পায়?
অধ্যাপক আবদুস সালাম: শাস্তি দেওয়ার বদলে আমি পুরস্কার দেওয়াটা বেশি পছন্দ করি। যে বা যেসব প্রতিষ্ঠান দূষণ করছে না, তাদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হোক। তাদের ভালো কাজের উদাহরণগুলো তুলে ধরা হোক। পুরস্কার দেওয়ার পাশাপাশি তাদের কর মওকুফের মতো উদ্যোগ নেওয়া যায়। তাতে অন্যরা উৎসাহিত হবে। তবে হ্যাঁ, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং দূষণকারী চিহ্নিত করে তাদের যথাযথ সাজার প্রক্রিয়া তো রাখতেই হবে। তা যে খুব বেশি হয়, তা মনে হয় না।
প্রথম আলো: বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আপনার সুপারিশগুলো কী থাকবে?
অধ্যাপক আবদুস সালাম: আমার একমাত্র সুপারিশ হলো দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের একটি ভিশন বা লক্ষ্য থাকতে হবে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। আমরা এমন পরিকল্পনা করতে পারি যে এখন পিএম ২.৫–এর মাত্রা ৭৬ থেকে ১০ বছরের মধ্যে কমিয়ে আমরা সহনীয় মাত্রায় আনব। পর্যায়ক্রমে এটি করতে হবে। ২ বছর, ৫ বছর বা ১০ বছরের লক্ষ্য ধরে এগোতে হবে। যেমন আমাদের পাশের দেশ ভারতের দিল্লিতে তারা একটি লক্ষ্য নির্দিষ্ট করেছে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করছে। আমাদের এমন উদ্যোগ নেই।