চৈত্রের রোদজ্বলা দুপুর। বাইরের সুনসান ভাবটা কেটে যায় চারুকলার ভেতরে প্রবেশ করে। ঢাকঢোলের আওয়াজ, তার সঙ্গে শতাধিক শিক্ষার্থীর নাচ আর করতালির শব্দ। অনেকেরই হাতে–মুখে বাহারি রং, অনেকেই রং মাখার অপেক্ষায়। শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ ভবনের সামনে ‘দেবালয়’ নামের একতলা ঘর। যাঁরা রং মাখার অপেক্ষায়, তাঁদের রং দেওয়া হবে সেখান থেকে।
শিক্ষার্থীদের এই রঙের উৎসবে মাতার কারণকে অনেকেই বললেন নিছক একটি ‘চল’। পুরান ঢাকার ‘হোলি’ উৎসব থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই রং মাখার এই আয়োজন। চারুকলায় যেটির শুরু বছর সাতেক আগে। দিনটিতে লাল, হলুদ, সবুজ, বেগুনিসহ বাহারি রঙের আবির গায়ে মাখেন শিক্ষার্থীরা। রাঙিয়ে দেন অন্যকে। আবির ছোড়েন বাতাসেও।
চারুকলার প্রিন্টমেকিং বিভাগের ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মশিউর রহমান বলছিলেন, ‘২০১০-১১ সালের দিকে চারুকলায় এই উৎসবের শুরু। পুরান ঢাকার হোলি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তখন শুধু পানি ছিটানো হতো। এখন শুকনো আবির ছিটানো হয়। দিনে দিনে যেটি সর্বজনীনতা পেয়েছে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার চারুকলা প্রাঙ্গণে ঘণ্টা তিনেকের ওই আয়োজনের পুরোটাজুড়েই ছিল আবির মাখামাখি আর ঢোলের তালে নাচ। দেবালয়ের সামনে থেকে আবিরের রং মাখিয়ে নেচেগেয়ে শিক্ষার্থীরা ঘুরে বেড়ান পুরো চারুকলা প্রাঙ্গণ। কেউ চুলে মেখেছেন বেগুনি, সবুজ, কারও আবার মুখের পুরো অংশটাই ঢেকে গেছে লাল, হলুদ রঙে। রঙের ছটায় নতুন নকশা পেয়েছে শিক্ষার্থীদের পরনের সাদা টি-শার্ট।
রঙের এ খেলা ছুঁয়ে গেল সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা তরুণ ডেনিয়েল উইল্ডারকেও। বাংলাদেশ ভ্রমণে আসা এ তরুণ রঙের উৎসব সম্পর্কে জানতে পেরেছেন বাংলাদেশি বন্ধুর কাছে। চারুকলা প্রাঙ্গণে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন পুরো শরীর রঙে মাখা। বলছিলেন, বাংলাদেশে এটাই তাঁর প্রথম আসা। রং মাখিয়ে উৎসব উদ্যাপনের অভিজ্ঞতাটাও নতুন।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকেই চার বছর ধরে চারুকলার রঙের উৎসবে আসেন অঙ্কিতা কর। তিনি বলছিলেন, এই উৎসবের আনন্দটাই হলো বন্ধুদের রং মাখানো। উৎসবে এসেও অনেকে রং মাখতে চান না। তখন বাকি বন্ধুরা মিলে তাঁর পিছে ছোটেন। রং মাখতে না চাওয়ায় তাঁর গায়ে আরও বেশি করে রং মাখানো হয়।
উৎসবের পুরোটা সময়জুড়ে শুধু ঢাকের শব্দই বেজেছে। কিন্তু বকুলতলায় আলাপচারিতার সময় বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী রূপম ইসলাম বলছিলেন, রঙের উৎসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের রচিত গানের কথা ‘যা ছিল কালো–ধলো/ তোমার রঙে রঙে রাঙা হল/ যেমন রাঙাবরন তোমার চরণ, তার সনে আর ভেদ না র’ল।।’ রঙের উৎসবও যেন অংশগ্রহণকারীদের চরণে কোনো বর্ণের ভেদ রাখল না।