রাজধানীর বাসাবাড়িতে বিদ্যমান পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় বদল আনতে চায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। রাজধানীবাসীর পয়োবর্জ্যের নিষ্কাশন নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব করার জন্য একটি পথনকশা (রোডম্যাপ) প্রস্তুত করেছে সংস্থাটি। এর মূল উদ্দেশ্য বাসাবাড়িসহ যেখানে পয়োবর্জ্য উৎপন্ন হবে, সেখানেই সেপটিক ট্যাংকসহ পয়োবর্জ্য ব৵বস্থাপনা গড়ে তোলা।
স্যানিটেশন বিশেষজ্ঞ ও ডিএনসিসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বের অন্যতম দুর্বল পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ঢাকায়। গত ৪০ বছরেও ঢাকায় কোনো পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই পয়োবর্জ্যের উৎসেই ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ইউনিসেফের স্যানিটেশন পরামর্শক মুজিবুর রহমানের একটি গবেষণাপত্রে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি দৈনিক ৯১ লিটার পয়োবর্জ্য নিঃসরণ করেন। ঢাকা ওয়াসার আওতাধীন জনসংখ্যা এক কোটি হিসাবে রাজধানীতে দৈনিক ৯১০ মিলিয়ন লিটার পয়োবর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে পয়োবর্জ্য ব৵বস্থাপনার ঘাটতি এবং বাসাবাড়িতে সেপটিক ট্যাংক না থাকায় দৈনিক ৯০০ মিলিয়ন লিটার অপরিশোধিত পয়োবর্জ্য সরাসরি মিঠাপানির উৎসে চলে যায়।
মুজিবুর রহমান বলেন, বাসাবাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ সরাসরি বৃষ্টির পানির নালায় দেওয়া রয়েছে। কেন্দ্রীয় পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার অপেক্ষা করতে করতে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকাকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না। বিশ্বের অনেক দেশেই উৎসেই পয়োবর্জ্যের ব্যবস্থাপনা করে সুফল পাওয়া গেছে। জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের এই কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে।
ঢাকায় বর্তমানে ৯৩৪ কিলোমিটার পয়োনালা রয়েছে। ৮০ শতাংশের বেশি এলাকায় পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। বিদ্যমান পয়োনালাগুলোর বেশির ভাগ অকেজো। বিভিন্ন এলাকার পয়োবর্জ্য জমা করার ব্যবস্থা কাজ করে না। তবে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ দাবি করে, ঢাকার ২০ ভাগ পয়োবর্জ্য শোধন করা হচ্ছে। বাস্তবে রাজধানীর ২ ভাগের কম পয়োবর্জ্য পরিশোধন হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মুজিবুর রহমানের গবেষণাপত্রে। অধিকাংশ পয়োবর্জ্য কোনো না কোনো পথে খাল ও নদীতে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের ঘোষণা করা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৬ নম্বর অভীষ্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে হবে। ২০১৩ সালে ঢাকা মহানগরীর পয়োনিষ্কাশন মহাপরিকল্পনা তৈরি করে ঢাকা ওয়াসা। সে অনুসারে ঢাকার চারপাশের নদীদূষণ রোধে উত্তরা, মিরপুর, রামপুরা, রায়েরবাজার ও পাগলায় (দ্বিতীয়) পাঁচটি শোধনাগার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে গত ৯ বছরে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের গতি ধীর।
বাসাবাড়িতে নিজস্ব পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাড়ির মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা দুটি বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যেসব এলাকায় ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন নেটওয়ার্ক রয়েছে, সেখানে ওয়াসা পয়োনিষ্কাশন বিল নেয়। সেখানকার কোনো বাসায় নিজস্ব পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকলেও ওয়াসাকে বিল দিতে হবে কি না। আর অনেক বাড়ির মালিকের পক্ষে সেখানে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা তৈরির সামর্থ্য নেই, তাঁদের অর্থের জোগান আসবে কোথা থেকে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, কোনো বাসাবাড়িতে নিজস্ব পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকলে ওয়াসাকে বিল দেওয়ার প্রশ্ন আসে না। এই বিষয়ে ওয়াসার সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আর উৎসে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি খাতকে যুক্ত করা হবে। যাঁদের সামর্থ্য নেই, তাঁরা কীভাবে এই ব্যবস্থাপনা চালু করবেন, সেটি নিয়ে প্রটোকল তৈরি করা হবে।
যা আছে ডিএনসিসির রোডম্যাপে
ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষের পয়োবর্জ্য নিয়ে তৈরি করা রোডম্যাপটিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ২০২২ সালের মধ্যে পয়োবর্জ্যের কারণে পানিদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা। গণমাধ্যমের সঙ্গে বৈঠক, অঞ্চলভিত্তিক সচেতনতা সভা, ডিএনসিসি, রাজউক, ওয়াসা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে আনুষ্ঠানিক সমন্বয়ের কাঠামো তৈরি করা, অন্যান্য দেশের পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভালো উদাহরণগুলো পর্যালোচনা স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অন্যতম। এ ছাড়া স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজউকের সহায়তা নিয়ে রাজধানীর সব ধরনের অবকাঠামোর সেপটিক ট্যাংক–সংক্রান্ত একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করা হবে।
মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী, পয়োবর্জ্যের নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব নিষ্কাশন নিশ্চিত করতে ২০২৩ সালের মধ্যে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বের (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ–পিপিপি) প্রটোকল প্রস্তুত করবে ডিএনসিসি। পয়োবর্জ্যের নিষ্কাশন কার্যক্রমে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করাই এর উদ্দেশ্য। ডিএনসিসির একটি ওয়ার্ডে (বস্তিসহ) বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পয়োনিষ্কাশন কাজে যুক্ত করা হবে।
ঢাকা ওয়াসার সহায়তায় পয়োবর্জ্য নেটওয়ার্ক এবং বৃষ্টির পানি পরিবহনের নালার একটি হালনাগাদ মানচিত্র (ম্যাপ) প্রস্তুত করা হবে। যেসব এলাকায় পয়োবর্জ্য নেটওয়ার্ক নেই, সেসব এলাকার বাসাবাড়িতে সেপটিক ট্যাংক বসানো ও সংস্কারকাজ করে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা হবে। বিভিন্ন এলাকার জন্য পয়োবর্জ্য শোধনাগার তৈরি এবং পয়োবর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহনসামগ্রী কেনা হবে।
২০২৪ সাল ও এর পরবর্তী সময়ের মধ্যে বৃষ্টির পানির নালায় এবং খাল, নদী ও লেকে পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন কমিয়ে আনা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার লক্ষ্য। বৃষ্টির পানির নালায় বাসাবাড়ির পয়োনিষ্কাশন সংযোগ বন্ধ করা, ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে এলাকাভিত্তিক শোধনাগার নির্মাণ, জলবায়ু সহনশীলতা এবং বিদ্যমান পয়োবর্জ্য নেটওয়ার্কের বিষয় মাথায় রেখে ড্রেনেজ নীতিমালা সংশোধন এবং সুউচ্চ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজস্ব পয়োবর্জ্য শোধনাগার গড়ে তোলা অন্যতম।
ঢাকার মতো নগরীর জন্য উৎসে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা আদর্শ হতে পারে বলে মনে করেন নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা শহরে পয়োবর্জ্যের নেটওয়ার্ক নতুন করে তৈরি করা অনেক কঠিন। বাসাবাড়িতে পয়োবর্জ্যের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সহজ। সরকারের এক সংস্থা বাসাবাড়িতে ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে বলছে, অন্যদিকে ওয়াসা শোধনাগার নির্মাণ করছে। সরকারকে সবার আগে পয়োবর্জ্যের বিষয়ে নীতি (পলিসি) ঠিক করতে হবে।