জাকিরের তিন ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করা মো. ইয়াসিন বাবার দেখানো পথেই সাদাছড়ি বানাচ্ছেন।
‘আমি তো চোখে দেখতে পাই না। তাই ছোট ছেলেরে বলছি, তুই সাদাছড়ি বানা, ব্যবসাটা কর। ছেলেই এখন ব্যবসার সব করে। ও ভালোই করতাছে।’ এসব কথা বলছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জাকির হোসেন (৮০)। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম ১৯৮৯ সালে সাদাছড়ি বানানো শুরু করেছিলেন।
রাজধানীর মিরপুরে তিনতলা পুরোনো আমলের স্যাঁতসেঁতে একটি বাড়িতে ‘জাকির হোয়াইট ক্যান ওয়ার্কস’ নামের কারখানা থেকেই সরকার, এনজিও এবং ব্যক্তি পর্যায়ের চাহিদামতো সাদাছড়ি তৈরি হচ্ছে।
জাকিরের তিন ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করা মো. ইয়াসিন বাবার দেখানো পথেই সাদাছড়ি বানাচ্ছেন। কোনো সমস্যায় পড়লে বাবার পরামর্শ নিচ্ছেন। তবে ইয়াসিনের ক্ষোভও কাজ করে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা এত বছর সাদাছড়ি বানিয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সেবা করলেন। এর জন্য সরকারি কোনো অনুদানই পাননি তিনি। এমনকি বাবার একটা স্বীকৃতি প্রাপ্য, তা–ও তাঁকে দেওয়া হয়নি। অনুদান না পাক, বাবা মারা যাওয়ার আগে স্বীকৃতিটা অন্তত পাক।’
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হিসেবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সহায়তা করা একটি সমিতির মাধ্যমে একজন ব্যক্তির সহায়তায় মিরপুরের বাড়িটি পেয়েছিলেন জাকির। বাড়িটি দোতলা ছিল। জাকির একতালা বাড়িয়ে তিনতালা করেছেন, তবে কাজ শেষ হয়নি এখনো। তিনতলায় থাকছেন জাকিরের মেয়ে। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে সন্তান নিয়ে মেয়ে এখানেই থাকেন। জাকিরের দুই ছেলে বিদেশ থাকেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁর হাই-হ্যালো সম্পর্ক। বলতে গেলে ছোট ছেলে ইয়াসিনই বাবা ও মা রাবেয়া বেগমের দেখভাল করছেন।
গত মঙ্গলবার বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় সাদাছড়ি বানানোর জন্য ভারী ভারী মেশিন ও সামগ্রী রাখা। বাড়ির দোতলা বারান্দায় বস্তায় ভরে রাখা হয়েছে সাদাছড়ি। সারা বছর তেমন অর্ডার মেলে না। তবে অক্টোবর মাসের আগে কিছু অর্ডার আসে। কেননা ১৫ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস। দিবসটিকে কেন্দ্র করে আগে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছ থেকে সাদাছড়ির অর্ডার পাওয়া যেত। বর্তমানে তা বন্ধ। সরকার আধুনিক বা সেন্সরযুক্ত সাদাছড়িকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বেসরকারি সংগঠনের কাছ থেকে অর্ডার পেলেও তার সব পূরণ করতে পারেননি বলে জানালেন ইয়াসিন। তিনি বলেন, ‘সাদাছড়ির চাহিদা ভালোই ছিল। তবে সাদাছড়ি বানানোর বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাত্র তিন হাজার সাদাছড়ি বানাতে পেরেছি। দিবসের আগে সব জায়গা মতো চলে যাবে।’
দেড় বছর বয়সে বাবা এবং মাত্র আড়াই বছর বয়সে মাকে হারান জাকির। ঢাকায় এসে তাঁর ঠাঁই হয় স্যার সলিমুল্লাহ এতিমখানায়। সেখানে তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি টেইলার্স মাস্টার হিসেবে কাজ করতেন। জাকিরসহ তিন ভাই এবং এক বোন ছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ১৯৬৯ সালে জাকির যখন বিয়ে করেন, তখনো চোখে দেখতেন। এখনো মনে আছে, তাঁর স্ত্রী রাবেয়া বেগম দেখতে সুন্দর ছিলেন। তবে তারপর আস্তে আস্তে দুই চোখের দৃষ্টি হারাতে থাকেন।
জাকির জানালেন, আন্তর্জাতিক এবং সরকারিভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সাদাছড়ি ব্যবহারের নিয়ম চালু হয়। মিরপুরের বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালে গিয়েছিলেন একটি সাদাছড়ির জন্য। ছয় মাস ঘুরতে হয়। তারপর সেখানে দায়িত্বে থাকা আইভি রহমান একটি সাদাছড়ি জাকিরের হাতে দিয়ে ৬০০ টাকা দিতে বলেন।
ইয়াসিন বললেন, ‘সরকার যদি একটু সহায়তা করে ব্যবসাটা ভালো করে করা যায়। আমরা বাবা-ছেলে মিলেই আধুনিক ও উন্নত মানে সাদাছড়ি বানাতে পারি।’
আজ বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস
প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস পালিত হয়।