বাজার বসল দোরগোড়ায়

বেইলি রিটজ্` অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বাসিন্দারা ভবনের গ্যারেজের খোলা জায়গাতেই কাঁচাবাজার বসানোর ব্যবস্থা করেছেন।ছবি: সংগৃহীত
বেইলি রিটজ্` অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বাসিন্দারা ভবনের গ্যারেজের খোলা জায়গাতেই কাঁচাবাজার বসানোর ব্যবস্থা করেছেন।ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে লকডাউনের বিধিনিষেধ ভাঙার ঢল যেমন রয়েছে, তেমনি একটি সচেতন পক্ষ রয়েছে, যারা নিয়ম মেনে নিজেদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। নিজেদের প্রয়োজনকেও কাটছাঁট করেছে। তবে অবরুদ্ধ সময় দীর্ঘ হওয়ায় কিছু প্রয়োজন না মিটিয়েও পারছে না। সে রকম একটি হলো কাঁচাবাজার। এখন কে না জানেন, ঘিঞ্জি পরিবেশে দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয় বলে কাঁচাবাজার করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য কতটা ঝুকিপূর্ণ।

পচনশীল এসব পণ্যের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে রাজধানীর কিছু এলাকার বাসিন্দারা তাই কাঁচাবাজারে না গিয়ে বাজারকেই বাড়ির দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছেন।

রাজধানীর ১ নম্বর বেইলি রোডের ‘বেইলি রিটজ’ অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বাসিন্দারা ভবনের গ্যারেজের খোলা জায়গাতেই কাঁচাবাজার বসানোর ব্যবস্থা করেছেন। ভবনটিতে ২৩২টি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। নিজস্ব একটি সোসাইটি রয়েছে। সোসাইটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সরকার লকডাউন ঘোষণার পর গত ২ মার্চ থেকে ভবনের বাসিন্দাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাইরের অতিথি নিয়ন্ত্রণ, ১২ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে দ্বিগুণ পরিমাণ বেতন দিয়ে ভবনের ভেতর থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করা, ভবনে প্রবেশের সময় হাত ধোয়া, লিফট ব্যবহার সীমিত করা, পুরো ভবনে জীবাণুনাশক স্প্রে করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২৩ জন নিরাপত্তাকর্মী আগে থেকেই ভবনের ভেতরে বাস করেন। বাসিন্দাদের শুকনা পণ্যের প্রয়োজন মেটাতে পাঁচ বছর ধরে ভবনের ভেতরে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর পরিচালনা করা হচ্ছে। স্টোরের কর্মীদের এখন ভবন ছেড়ে বাইরে যেতে দেওয়া হয় না।

সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক পরিমল চন্দ্র মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউনের কারণে ভবনের বাসিন্দারা বাইরে বের হচ্ছেন না। এই সময়ে ডিপার্টেমন্টাল স্টোরটি শুকনা খাবার, চাল, ডাল প্রভৃতি পণ্যের চাহিদা মেটালেও কাঁচাবাজার নিয়ে তীব্র সমস্যা দেখা দেয়। সপ্তাহখানেক আগে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের পক্ষ থেকে কাঁচাবাজার রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাসিন্দারা নিজেদের সুবিধামতো সময়ে নিচে নেমে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাঁচাবাজার কিনে নিচ্ছেন।

ভবনের একটি অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজের অধ্যাপক নাসরীন জেবিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একেবারেই ঘরবন্দী রয়েছেন। এই সময়ে ভবনের ব্যবস্থাপনায় কাঁচাবাজারের সমস্যা মিটেছে। তিনি ফোন করে বাজার যা যা লাগবে বলে দেন, নিরাপত্তাকর্মী সেইমতো বাজার দরজার কাছে রেখে যান।

বাসাবোর কদমতলা এলাকার দুটি পাশাপাশি গলির বাসিন্দারা ভিন্ন উপায়ে বাজার বাড়ির কাছে নিয়ে এসেছেন। ছবি: সংগৃহীত

ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, তিনিসহ ছয়জন কর্মীর মধ্যে তিনজন স্টোরের ভেতরের জিনিস বিক্রি করছেন। আর বাকি তিনজন কাঁচাবাজারের পণ্য বিক্রি করছেন। আড়াই শ বর্গফুটের স্টোরের বাইরে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের খোলা জায়গায় দূরত্ব রেখেই কেনাকাটা করতে পারছেন বাসিন্দারা। এরপরও তাঁরা সাদা দাগ কেটে দিয়েছেন দূরত্ব রেখে দাঁড়ানোর জন্য। মো. ইউসুফ জানান, তিনি নিজে কাওরানবাজার থেকে প্রতিদিন সব ধরনের শাকসবজি কিনে নিয়ে আসেন। প্রতিটি পণ্য পাঁচ–সাত কেজি করে কিনে আনেন। তিনি বলেন, বাসিন্দাদের অনুরোধে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজটি করছেন। লাভের বিষয়টি ভাবছেন না।

বাসাবোর কদমতলা এলাকার দুটি পাশাপাশি গলির বাসিন্দারা আরেকটু ভিন্ন উপায়ে বাজার বাড়ির কাছে নিয়ে এসেছেন। দুজন সবজি বিক্রেতা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভ্যানে করে গলির ভেতর প্রবেশ করেন। ওই সময়ের মধ্যে বাসিন্দারা পণ্য কিনে নিয়ে যান। এলাকার বাসিন্দা মুহাম্মদ আরিফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে এলাকার বেশির ভাগ মানুষ তা মেনে চলছিলেন না। তাঁরা কাঁচাবাজারের অজুহাতে সারা দিন বাইরে বের হতেন। এ অবস্থায় নিজেদের সুরক্ষার জন্য আমাদের ৪০ জন বাড়িওয়ালার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি সিদ্ধান্ত নিই যে কাঁচাবাজারগুলো লোকজনের বাড়ির কাছে নিয়ে আসব।’

আরিফুজ্জামান জানান, বলাকা লন্ড্রির গলি এবং শিশু নিকেতন স্কুলের গলি–এ দুটি গলিতে আনুমানিক পাঁচ শ লোকের বাস। বাড়িওয়ালারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রবেশপথে লোহার দরজা রেখেছেন আগে থেকেই। করোনাভাইরাসের পরিস্থিতির কারণে গেট তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। এখন এক দিন পরপর দুজন বিক্রেতা ভ্যানে করে কাঁচাবাজার নিয়ে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত গেটের ভেতরে প্রবেশ করেন। তিনি আরও বলেন, ‘দুই গলির ৯০ শতাংশ বাসিন্দাই আমাদের এ ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়ে তা মেনে চলছেন। তবে ১০ শতাংশ মানেন না। তাঁরা নিজেদের ইচ্ছেমতো বাজার করেন।’

কাঁচাবাজারের এমন অভিনব বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতি যত দিন স্বাভাবিক না হবে, তত দিন তাঁরা এভাবেই বাজার সমস্যার সমাধান করবেন। কারণ এই সময় নিজে সুস্থ থাকা এবং পরিবারের সদস্যদের সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি।