বায়িং হাউস কর্মকর্তা মো. সুলতান হোসেনের খুনিদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বায়িং হাউস কর্মকর্তা মো. সুলতান হোসেনের খুনিদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

বাঁচার জন্য চিৎকার করায় ব্যবসায়ীকে হত্যা

বায়িং হাউস কর্মকর্তা মো. সুলতান হোসেনের কাছে অনেক ডলার আছে, এমনটা মনে করেছিল ডাকাত দল। মতিঝিলের একটি মানি এক্সচেঞ্জ থেকে বের হয়ে তিনি যখন বাসে করে বাসায় ফিরছিলেন তখনই তার পিছু নেয় তারা। পল্লবীর পূরবী সিনেমা হলের পাশে নামার সঙ্গে সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয় তাকে। কিন্তু সুলতানের সঙ্গে কোনো ডলারই ছিল না। ভয় পেয়ে বাঁচার জন্য তিনি যখন চিৎকার করেন তখনই শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়। লাশটি ফেলে দেওয়া হয় মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অদূরে রাস্তার পাশের একটি ঝোপে।

মো. সুলতান হোসেন

সুলতান হোসেনকে ডাকাত দল মাইক্রোবাসে করে তুলে নেয় গত ১৪ জুলাই। বাড়ি না ফেরায় পরদিন তার ভাই মো. আবুল হোসেন তেজগাঁও থানায় একটি নিখোঁজ জিডি করেন। তার পরদিন অর্থাৎ ১৬ জুলাই তার লাশ মেলে সিঙ্গাইরের ঝোপে। এ ঘটনায় ১৮ জুলাই আবুল হোসেন অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করেন। তদন্ত করে প্রায় এক মাসের মাথায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ পুলিশ সুলতান হত্যার ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, গোয়েন্দা তথ্য ও তথ্য প্রযুক্তির ভিত্তিতে হত্যার অন্যতম আসামি ফরহাদ হোসেনকে শরিয়তপুর জেলার সখিপুর থানার সরকার গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত অ্যাম্বুলেন্স সহ মো. জালাল উদ্দিনকে (৩৫) গ্রেপ্তার করা হয়। একই দিন চক্রের মূল হোতা কাজী মো. আকবর আলী (৪৫), মো. সাহারুল ইসলাম (২১) এবং মো. আমিনুল ইসলামকে (৫০) পুরানা পল্টন লাইন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিদের কাছ থেকে ডাকাতি বা ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত র‍্যাবের দুটি জ্যাকেট, একটি হ্যান্ডকাফ, একটি ওয়্যারলেস সেট, একটি পিস্তল, পাঁচটি গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন, একটি ডামি পিস্তল এবং পিস্তলের কভার জব্দ করা হয়েছে।

ডিবির গুলশান অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. গোলাম সাকলায়েন প্রথম আলোকে বলেন, পরে গ্রেপ্তার চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আসামিরা জানিয়েছেন, ১৪ জুলাই মতিঝিল মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ব্যাগ হাতে বের হওয়ার পর সুলতান হোসেনকে অনুসরণ করতে থাকেন সাহারুল ও আমিনুল। সুলতান পল্টন মোড় থেকে বিআরটিসি বাসে উঠলে এই দুজনও তার আশপাশের সিটে বসেন। চক্রের অন্য সদস্যরা তখন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বাসটির পেছন পেছন রওনা হন। সুলতান ফার্মগেটে নেমে মিরপুরগামী শেখর বাসে ওঠেন। তখন সাহারুল ও আমিনুলও তার সঙ্গে বাস পরিবর্তন করেন। পেছনে আসতে থাকে অ্যাম্বুলেন্সটি। মিরপুরের পূরবী সিনেমা হলের একটু সামনে সুলতান বাস থেকে নামেন।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, সুলতান গাড়ি থেকে নামার পর তাকে অনুসরণ করে বাসে আসা ডাকাত দলের সদস্য সাহারুল ও আমিনুল ইশারা দিয়ে মনির ও আকবরকে দেখিয়ে দেয়। সড়ক বিভাজন পার হয়ে রাস্তার অপর পাশে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকবর, মনির ও ফরহাদ নিজেদের র‍্যাব সদস্য পরিচয় দিয়ে সুলতানের শার্টের পেছনের কলার ধরে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠান। এ সময় আকবরের হাতে ওয়ারলেস সেট, মনিরের গায়ে র‌্যাবের পোশাক, ফরহাদের গায়ে র‌্যাবের পোশাক এবং হাতে একটি হ্যান্ডকাফ ছিল। অ্যাম্বুলেন্স চলা শুরু হলে সুলতান বুঝতে পারেন এরা র‍্যাব সদস্য না। তিনি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে মনির জানায় তার কাছে কিছু পাওয়া না গেলে ছেড়ে দেওয়া হবে। আকবর তখন সুলতানের হাতে থাকা ব্যাগটি তল্লাশি করে। কোনো ডলার না পেয়ে সুলতানকে সবাই মিলে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে তিনি আবারও চিৎকার করতে থাকেন। তখন অ্যাম্বুলেন্সের সামনের সিটে বসা মনির চালক জালাল উদ্দিনের কাছ থেকে একটি গামছা নিয়ে সুলতানের গলায় পেঁচিয়ে ধরে। পেছনের সিটে বসা আকবর লোকটির হাত এবং ফরহাদ পা চেপে ধরে। এক সময় সুলতান শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। গাড়িটি গাবতলী-হেমায়েতপুর-সাভার হয়ে নবীনগর বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালে এক একে মনির, আকবর, ফরহাদ, সাহুরুল ও আমিনুল গাড়ি থেকে নেমে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে চালক জালাল লাশটিকে নিয়ে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সিঙ্গাইর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছে রাস্তার পাশের ঝোপে লাশটি ফেলে চলে যান।

ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এদের মধ্যে দলনেতা হচ্ছে ফরহাদ। দীর্ঘদিন ধরে এই চক্রটি এভাবে মানুষকে তুলে নিয়ে সবকিছু কেড়ে নিয়ে দূরে কোনো এলাকায় ফেলে রেখে চলে যায়। সুলতান হত্যার সঙ্গে জড়িত ছয়জনের মধ্যে মনির বাদে বাকি সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া ইব্রাহিম ও রুহুল নামে আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যারা এই চক্রটির সঙ্গে মিলেই চাঁদপুরের এক ব্যবসায়ীর সাড়ে তিন কেজি রুপা ও কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছিল।