করোনায় কঠোর লকডাউনে বদলে যাওয়া জীবনযাত্রার প্রভাব পড়েছে ইফতারি বাজারেও। করোনার আগে রমজান মাসে দুপুরের পর থেকে পুরান ঢাকার চকবাজারের শাহি মসজিদ রোডে ঐতিহ্যবাহী বাহারি সব ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসতেন ব্যবসায়ীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরান ঢাকার বাসিন্দারাসহ নগরের নানা প্রান্তের মানুষ ইফতারসামগ্রী কেনার জন্য সেখানে ভিড় করতেন।
রমজান মাসজুড়ে মানুষের পদচারণায় মুখর থাকা চকবাজারের সেই শাহি মসজিদ রোড আজ দেখা গেল ফাঁকা। সড়কে নেই কোনো ইফতারসামগ্রী। হাতে গোনা তিন থেকে চারটি স্থায়ী দোকানে ইফতারসামগ্রী বিক্রি করতে দেখা যায়। অন্য সময় হরেক পদের যেসব ইফতারসামগ্রীর দেখা মিলত, এবার দেখা যায়নি। তবে চকবাজারের বিখ্যাত শাহি জিলাপি, শাহি পরাটা, সুতি কাবাবের দেখা মেলে।
আজও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাহি মসজিদ রোডে মানুষের আনাগোনা কিছুটা বাড়তে থাকে। ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি না মেনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন কেউ কেউ। সড়কে মানুষের এমন জটলা দেখে সেখানে চলে আসে চকবাজার থানা–পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়, সবাই যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইফতারসামগ্রী কেনেন। ইফতারসামগ্রী কেনা হলে সোজা বাড়ি ফিরতে বলেন।
করোনায় চকবাজারের রোডে ইফতারসামগ্রীর চিরচেনা দোকান না দেখতে পেয়ে কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দা ইরফান আলী। তবে করোনার প্রকোপের সড়কে দোকান না বসানোয় ভালোই হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। ইরফানের আশা, দেশ থেকে করোনার প্রকোপ কমে যাবে। নিশ্চয় আগামী বছর আবার পুরোনো রূপে ফিরে যাবে চকবাজারের শাহি মসজিদ রোড। আবার মানুষের ঢল নামবে। মানুষ ফিরে পাবে তার স্বাভাবিক জীবন।
চকবাজারের আলাউদ্দিন সুইটমিট ও আনন্দ সুইটমিট নামের দোকানে ইফতারসামগ্রী কেনার জন্য পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের ভিড় করতে দেখা যায়। চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতারসামগ্রীর মধ্যে আছে বড় বাপের পোলায় খায়, সুতি কাবাব, জালি কাবাব, শাহি পরোটা, শাহি জিলাপি, দইবড়া, বাটার নান, মুরগি আচারি। এক কেজি ওজনের একেকটি শাহি জিলাপির দাম দেড় শ থেকে দুই শ টাকা।
বেইলি রোডের গুটিকয়েক স্থায়ী দোকানে দুপুরের পর থেকে ইফতারের পসরা সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় ছিলেন দোকানিরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ক্রেতা ভিড় করতে থাকেন। তবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ইফতারি বিক্রির খবর পেয়ে ছুটে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পুলিশের পক্ষ থেকে দোকানিদের কড়া ভাষায় বলে দেওয়া হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই যেন ইফতারসামগ্রী বিক্রি করা হয়।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বেইলি রোডের কয়েকজন দোকানি প্রথম আলোকে জানান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইফতারসামগ্রী বিক্রির চেষ্টা করে আসছেন তাঁরা। লোকজনকে বলার পরও তাঁরা ন্যূনতম শারীরিক দূরত্ব না মেনে দোকানের সামনে ভিড় করছেন।
সময়ের ফেরে অনলাইনে খাবার বিক্রি যে বেড়েছে, সেটি টের পাওয়া গেল আজ বুধবার বেইলি রোডে। দুপুরের পর সড়কে অন্তত ২০ জন যুবক পাওয়া গেল, যাঁদের কাঁধে বড় ব্যাগ, যারা ইফতারির পার্সেল নেওয়ার জন্য এসেছেন। ইফতারির পার্সেল নিয়ে যথাসময়ে পৌঁছে দেবেন ক্রেতার বাসায়।
পাঠাও ফুডের আলম হোসাইন বললেন, সারা দিনে প্রায় আটটি ইফতারির পার্সেল পৌঁছে দেওয়ার অর্ডার পেয়েছেন। ইফতারের আগে এসব পার্সেল নিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবেন। রাস্তা ফাঁকা, তাই যথাসময়ে পৌঁছে দিতে পারবেন।
কঠোর সরকারি বিধিনিষেধে রেস্তেরাঁয় বসে খাবার সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। তবে অনলাইনে খাবারের পার্সেল বিক্রির অনুমতি আছে খাবার দোকানগুলোর। বেইলি রোডে অনলাইনে ইফতারির পার্সেল বিক্রি হয়েছে বেশি।
বেইলি রোডের নামকরা ‘নবাবী ভোজ’ নামের দোকানটির কর্মচারী আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রত্যেক বছর যেভাবে ইফতারি কেনার জন্য মানুষের ভিড়ভাট্টা হয়, এ বছর সেই ভিড় নেই। রাস্তায় ইফতারির কোনো দোকান নেই। তবে অনলাইনে ইফতারির অনেক পার্সেল বিক্রি হচ্ছে।’
কঠোর লকডাউনের ভেতর বেইলি রোডে ইফতারি কিনতে আসা ব্যবসায়ী আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রমজান মাসের প্রায় প্রতিটি দিন তিনি বেইলি রোড থেকে ইফতারি কেনেন। রাস্তাজুড়ে বাহারি সব ইফতারি আর মানুষের কোলাহলে মুখর থাকে এই রোড। কিন্তু করোনায় পাল্টে গেছে সবকিছু। বেইলি রোডের চিরচেনা ইফতারির বাজার আজ হয় তো নেই। তবে আশা করি, আগামী বছর আবার আগের রূপে ফিরে যাবে বেইলি রোডের ইফতারি বাজার।’