ফেলে রাখা মেডিকেল বর্জ্যে করোনা সংক্রমণের ভয়

করোনা রোগীদের চিকিৎসা কেন্দ্র কমলাপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল মেডিকেল বর্জ্যগুলো সম্প্রতি এভাবে বাইরে ফেলে রেখেছিল। ছবি: সংগৃহীত
করোনা রোগীদের চিকিৎসা কেন্দ্র কমলাপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল মেডিকেল বর্জ্যগুলো সম্প্রতি এভাবে বাইরে ফেলে রেখেছিল। ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের একটি কমলাপুরের রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল। ২ মে থেকে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেছে সরকারি এই হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা মেডিকেল বর্জ্য বায়োসেফটিক্যাল ব্যাগে ভরে না রেখে তা বাইরের ডাস্টবিনে ফেলে রাখছে।

কমলাপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ ফিরোজ আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, 'প্রথম দিকে কিছুদিন মেডিকেল বর্জ্য ডাস্টবিনে ফেলে রাখা হয়েছিল। এখন আর মেডিকেল বর্জ্য বাইরে ফেলে রাখা হয় না। একটি ড্রামের ভেতর রাখা হচ্ছে।'

ঢাকা মহানগরে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, কমলাপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের মতো আরও অনেক হাসপাতাল মেডিকেল বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করছে না। হাসপাতালের সামনে যত্রতত্র স্তূপ করে ফেলে রাখছে।

সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) জানিয়েছে, দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভসসহ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ টন। এ সময়ে ঢাকায় ১ হাজার ৩১৪ টন সার্জিক্যাল হ্যান্ডগ্লাভস এবং সার্জিক্যাল মাস্কের ৪৪৭ টন বর্জ্য তৈরি হয়েছে। এসব বর্জ্যের বড় একটি অংশ যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। এতে করে ভয়াবহভাবে করোনার গণসংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

করোনা রোগীদের চিকিৎসা কেন্দ্র কমলাপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল মেডিকেল বর্জ্যগুলো সম্প্রতি এভাবে বাইরে ফেলে রেখেছিল। ছবি: সংগৃহীত

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, 'মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভসসহ যেকোনো ধরনের মেডিকেল বর্জ্য বাইরে ফেলে রাখা উচিত নয়। সরকারি-বসরকারি যে প্রতিষ্ঠানই হোক, তাদের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যে গাইডলাইন আছে, সেগুলো অনুসরণ করে কাজ করা উচিত। করোনার এই সময়ে যেভাবে মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস যেভাবে যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে, তাতে করোনার সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। যত্রতত্র ফেলা এসব বর্জ্য থেকে সংক্রমণ মানুষ থেকে মানুষে ছড়াবে। কাক মুখে নিয়ে আরেক জায়গায় ফেলবে, সেখান থেকে ছড়াবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উচিত মেডিকেল বর্জ্যগুলো অটোক্লেভস মেশিনের মাধ্যমে জীবাণুমক্ত করে তা বায়োসেফটিক্যাল ব্যাগে ভরে রাখা। পরে এসব বর্জ্য উচ্চতাপমাত্রায় পুড়িয়ে ফেলতে হবে।'

করোনাকালে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে থেকে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের ত্রুটি ছিল। আর এই সময়ে যদি কোনো হাসপাতাল মেডিকেল বর্জ্যগুলো হাসপাতালের সামনে ফেলে রেখে দেয়, সেটি অন্যায়। করোনার সংক্রমণের ঝূঁকি তৈরি করবে।’

যত্রতত্র মেডিকেল বর্জ্য
গত ৮ মার্চ করোনা ভাইরাস শনাক্তের পর থেকে দেশে ব্যাপক হারে মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস, গগলস, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের চাহিদা বেড়ে যায়। দিনদিন এসব জিনিসের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছে ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ। মারা গেছে ৫২২জন। আইইডিসিআরের হিসাব বলছে, দেশের মোট আক্রান্ত রোগীদের ৫৭ শতাংশই ঢাকা মহানগরের বাসিন্দা। করোনায় সংক্রমিত রোগীদের একটা বড় অংশ বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসা নিচ্ছে। বাসায় সার্জিকাল মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভসসহ নানা ধরনের মেডিকেল সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো সাধারণ বর্জ্যরে সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর বদরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার সময়ে ঢাকা মহানগরের মানুষ মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস, পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ব্যবহার করছে। হাসপাতালের মেডিকেল বর্জ্যগুলো আলাদাভাবে নিয়ে তা পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা মাস্কসহ অন্যান্য বর্জ্য করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করছে। এগুলো জীবাণুমুক্ত না করে সাধারণ বর্জ্যরে সঙ্গে ফেলে দেওয়ায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ অনেকের করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এই বর্জ্যগুলো কীভাবে আলাদা করে ব্যবস্থাপনা করা যায়, সেটা নিয়ে আমরা পরিকল্পনা করছি।’

ঢাকা মহানগরের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত চারজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, করোনার কারণে মেডিকেল বর্জ্যরে ধরন আগের থেকে বদলে গেছে। আগে যেখানে প্রতিদিন ১৩ থেকে ১৪ টন মেডিকেল বর্জ্য তৈরি হতো, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ থেকে ৪ টনে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুযায়ী, মেডিকেল বর্জ্যগুলো অটোক্লেভস মেশিনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করে তা বায়োহ্যাজার্ড ব্যাগে ভরে রাখার কথা। তবে দু-একটি হাসপাতাল ছাড়া কেউই মেডিকেল বর্জ্যগুলো জীবাণুমুক্ত করে বায়োসেফটিক্যাল ব্যাগে ভরে রাখছে না। অনেক হাসপাতাল মেডিকেল বর্জ্যগুলো হাসপাতালের সামনে স্তূপ করে রাখছে।

১৬ বছর ধরে ঢাকা মহানগরে প্রিজম বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি সংগঠন হাসপাতালের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে আসছে। সংস্থাটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ক মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার আগের মেডিকেল বর্জ্য আর এখনকার মেডিকেল বর্জ্যরে মধ্যে অনেক পার্থক্য। আগের মেডিকেল বর্জ্যে সংক্রামক ব্যধি ছড়ানোর ঝুঁকি ছিল না বললেই চলে। আর এখনকার প্রতিটা মেডিকেল বর্জ্যের মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, দু-একটি হাসপাতাল ছাড়া কেউই নিয়ম মেনে মেডিকেল বর্জ্যগুলো অটোক্লেভ মেশিনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করে বায়োসেফটিক্যাল ব্যাগে ভরে রাখে না।’

মেডিকেল বর্জ্যগুলো মাতুয়াইলে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ছবি: সংগৃহীত

মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থপনায় যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঢাকা মহানগরে মেডিকেল বর্জ্যগুলো ভালোভাবে জীবাণুমক্ত করে রাখছে আইইডিসিআর। তাদের অটোক্লেভস মেশিন রয়েছে। আর ঢাকার কোভিড হাসপাতাল কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল নিজেরা মেডিকেল বর্জ্যগুলো পুড়িয়ে ফেলে। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল, মিটফোর্ড, মুগদা, সোহরাওয়ার্দীসহ সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করে তা পুড়িয়ে ফেলছে প্রিজম।

মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে অনেক মেডিকেল বর্জ্য হয়। এখন নতুন ধরনের মেডিকেল বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। হাসপাতালে প্রতিদিন এক হাজার পিপি ব্যবহার হচ্ছে। এসব মেডিকেল বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা আছে। প্রতিটি মেডিকেল বর্জ্য বায়োহ্যাজার্ড ব্যাগে ভরে রাখা হয়। পরে প্রিজমের লোকজন এসব ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছেন। হাসপাতালের ভেতর কোথাও মেডিকেল বর্জ্য ফেলে রাখা হয় না।’

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের দুই প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা জানালেন, ঢাকা মহানগরের বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাধারণ বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করে তা মাতুয়াইল ও আমিনবাজারে নেওয়া হয়। আর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য মাতুয়াইলে প্রিজমের নিজস্ব প্লান্ট রয়েছে। সেখানে এসব বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা হয়।

মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন অনুযায়ী প্রতিটা হাসপাতালে কমপক্ষে একজন করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কথা। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই পদে লোক নিয়োগ দেয় না। সাধারণত হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ড মাস্টারকে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অধিকাংশ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে বলে মনে করেন প্রিজম বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী পরিচালক খন্দকার আনিসুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ঢাকা মহানগরে আমার ১০০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন। ১০টি গাড়িতে করে মেডিকেল বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করে তা মাতুয়াইলে নিয়ে এসে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আমরা হাসপাতালগুলোকে বারবার বলছি, আপনারা মেডিকেল বর্জ্যগুলো বায়োহ্যাজার্ড ব্যাগে ভরে রাখুন। এসব মেডিকেল বর্জ্য সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করে দিলে ঝুঁকির মাত্রাটা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু বর্জ্যগুলো অধিকাংশ ড্রামের ভেতর রেখে দেওয়া হয়।’ 
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, করোনার এই সময়ে মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝূঁকি তৈরি করেছে। ঢাকার প্রতিটা বাড়িতে এই ধরনের বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। আবার হাসপাতালে এই ধরনের বর্জ্য বেড়ে গেছে। এসব বর্জ্য যদি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না  করা হয়, তাহলে এর পরিণতি খারাপ হবে। করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে।