ফেলনা পোস্টার দিয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের খাতা, ঠোঙা

জানুয়ারি মাসে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন উপলক্ষে প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল ঢাকা। মাথার ওপরে তাকালে এসব পোস্টার ছাপিয়ে উঁচু দালান বা আকাশ দেখাও কঠিন হয়ে পড়ে নগরবাসীর জন্য। হাঁটতে গেলেও পায়ে-পায়ে ঠেকেছে পোস্টার-লিফলেট। এসব পোস্টার আবার ছিল প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো। পোস্টারের এমন বাহার ও ব্যবহার নিয়ে বেশ সমালোচনাও হয়েছে। নির্বাচন শেষ, জল্পনা আলোচনাও শেষ। এখন এই পোস্টার সরানোর কথা বলছেন সবাই। তবে এসব পোস্টার বা লিফলেট ময়লার ভাগাড়ে না ফেলে এর ভিন্ন ব্যবহার করতে চাইছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।

উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের ফেলনা পোস্টার সংগ্রহ করছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। ছবি: বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজ থেকে
উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের ফেলনা পোস্টার সংগ্রহ করছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। ছবি: বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজ থেকে

সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে কাজ করা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন গতকাল রোববার থেকে মিরপুর, শ্যামলী, শেওড়াপাড়া এলাকার নির্বাচনী পোস্টার সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। ফেসবুকে এক পোস্টের মাধ্যমে তারা জানিয়েছে, এসব পোস্টার-লিফলেট খাতা, ঠোঙা ও প্যাকেট বানানোর কাজে ব্যবহার করা হবে।

প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা শাখার প্রধান সালমান খান প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো জিনিস বা ওয়েস্ট ম্যাটেরিয়াল পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলার বিষয় নিয়ে তাঁদের একটি ক্যাম্পেইন আছে। এ বছর শীত শুরু হওয়ার আগেই তাঁরা শীতের পুরোনো পোশাক সংগ্রহ করে ধুয়ে পরিষ্কার করে তা অসহায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করেছেন। তাঁরা এসব করে থাকেন এক টাকায় আহার প্রজেক্টের অধীনে। পোস্টার-লিফলেটের পুনর্ব্যবহারও এই প্রজেক্টের অধীনে হচ্ছে।

সালমান খান বলেন, ‘নির্বাচনে এক মাস ধরে আমরা দেখলাম যে পুরো রাজধানীতে লাখ লাখ পোস্টার টাঙানো হয়েছে। নির্বাচনের পর থেকে কিন্তু এর আর কোনো প্রয়োজন নেই। ওই পোস্টারগুলো কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়ে আমরা ভাবতে থাকি। আমাদের বিদ্যানন্দ শিশু নিকেতনে যেসব শিক্ষার্থী পড়ে, ওদের প্রচুর খাতা দরকার হয়। এই পোস্টার বা লিফলেটের অনেকগুলোর এক পাশ প্রিন্ট করা থাকলেও আরেক পাশ সাদা। ওই সাদা অংশটুকু লেখার উপযোগী করে আমরা খাতা তৈরি করে দেব আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের। এ জন্যই আমরা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে পোস্টার সংগ্রহ করছি। গত দুই দিনে আমরা এক লাখের ওপর পোস্টার-লিফলেট সংগ্রহ করতে পেরেছি।’ তিনি জানান, বিদ্যানন্দ শিশু নিকেতনে সারা দেশে প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

ফেলনা পোস্টার দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বানানো খাতা।

অনেক পোস্টাররে দু পাশেই প্রিন্ট করা। সেগুলো নিয়েও বিদ্যানন্দের ভাবনা আছে। প্রতি রোজায় এই প্রতিষ্ঠান অসহায় মানুষের মধ্যে ইফতারি ও সাহরি বিতরণ করে। সে সব প্যাকেজিংয়ে তারা কাগজের ঠোঙা ব্যবহার করে। দুপাশ প্রিন্ট করা এই পোস্টারগুলো দিয়ে তারা ওই ঠোঙা বানাবে।

একই সঙ্গে পোস্টারে ব্যবহার করা প্লাস্টিকগুলোও ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে চায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। সালমান বলেন, ‘এই প্লাস্টিকটাও আমরা কাজে লাগাব। আমরা যে শীতবস্ত্র বিতরণ করি, সেটার প্যাকেট তৈরি করব এবং যেগুলো ব্যবহার করতে পারব না সেসব প্লাস্টিক দিয়ে দেব যারা এগুলো রিসাইকেল করে তাদের।’ এ ছাড়া পোস্টার ঝোলানোর রশি দিয়ে চাল-ডাল বিতরণের প্যাকেজিংয়ে ব্যবহার করবেন বলে জানান সালমান।

অর্থাৎ, নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত পোস্টার-লিফলেটের কোনো অংশই বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ফেলে নষ্ট করতে চায় না। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা এসব পোস্টার-লিফলেট সংগ্রহের কাজ করছেন।

স্বেচ্ছাসেবকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র আতিকুল ইসলাম ও বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা। ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা জানালেন, কাউন্সিলররা নিজেরাই তাঁদের কাছে পোস্টার তুলে দিচ্ছেন। খিলগাঁও, মিরপুর, শ্যামলী ওয়ার্ডের বিভিন্ন প্রার্থীরা যোগাযোগ করেছেন। স্বেচ্ছাসেবকেরা তা সংগ্রহ করে নিয়ে আসছেন। নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী বা যে প্রার্থীরা নির্বাচনের আগে সেভাবে পোস্টারগুলো ব্যবহার করতে পারেননি, তাঁরাও ফোন দিচ্ছেন। বলছেন, বাসায় জমে থাকা পোস্টারগুলো নিয়ে আসতে।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক সুলতানা জান্নাত প্রথম আলোকে বলেন, দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এসব পোস্টার সংগ্রহ করে আবর্জনা হিসেবে হয়তো পুড়িয়ে ফেলবে। ফাউন্ডেশন ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ সেসব পোস্টার না পুড়িয়ে ফাউন্ডেশনকে দিয়ে দিতে অনুরোধ জানিয়েছে। ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরাই তা নিয়ে আসবেন।

এসব পোস্টার দিয়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এতিম ও অসচ্ছল শিশুদের জন্য খাতা তৈরি করা হবে। ছবি: বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজ থেকে

এই ‘অপ্রয়োজনীয়’ জিনিস প্রয়োজনীয় করার ভাবনা প্রসঙ্গে সালমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিদ্যানন্দের চ্যারিটিকে শিক্ষার পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। অর্থাৎ, এই ফাউন্ডেশন এমন একটা প্রতিষ্ঠান হোক, যেখান থেকে মানুষ চ্যারিটির আইডিয়া পাবে। আমাদের পক্ষে হয়তো সব পোস্টার সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু আরও যাঁরা অসহায় মানুষের জন্য কাজ করেন, তাঁরাও তাঁদের নিজ এলাকা থেকে এভাবে পোস্টার নিয়ে তা কাজে লাগাতে পারেন।’