গুলশান-বনানীতে উঁচু ভবন

‘ফি’ নিয়ে রাজউকই ভেঙেছে বিধিমালা

গুলশান-বনানীর আবাসিক এলাকায় নিয়ম ভেঙে ৩২ তলা পর্যন্ত ভবন করার অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। ১৫টি ভবনের মধ্যে ৯টির নির্মাণকাজ চলছে।

  • ১৫টি প্লটে ভবন নির্মাণে নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চতার অনুমোদন দিয়েছে রাজউক।

  • প্লটের জমি রূপান্তর করতে প্রতি কাঠার ফি নেওয়া হয়েছে ৫ লাখ টাকা।

  • বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কমিটি হলেও এখনো প্রতিবেদন জমা হয়নি।

  • আবাসিক প্লটের অনাবাসিক রূপান্তরে প্লটের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

প্রচলিত বিধি অনুযায়ী ঢাকার গুলশান ও বনানীর আবাসিক প্লটে ১৪ তলার ওপর ভবন নির্মাণের সুযোগ নেই। কিন্তু এই এলাকার ১৫টি আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তর করে তাতে ৩২ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। বিধি লঙ্ঘিত হওয়ায় এখন রাজউকের দেওয়া অনুমোদন বাতিল করতে যাচ্ছে নগর উন্নয়ন কমিটি। গত মাসে অনুষ্ঠিত কমিটির সর্বশেষ সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

রাজউকের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিটি প্লটের জমি রূপান্তর করতে প্রতি কাঠায় পাঁচ লাখ টাকা ফি নিয়েছে রাজউক। ইতিমধ্যেই ১৫টি ভবনের মধ্যে ৯টি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে।

বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে রাজউক এ কাজ করেছে। প্লটগুলো রূপান্তরের পর নিয়মনীতি না মেনে ভবন নির্মাণের নকশা পাস করা হয়েছে। সে অনুযায়ী কয়েকটি প্লটে ভবন নির্মাণও শুরু হয়েছে। নগর উন্নয়ন কমিটি সব বাতিল করতে বলছে। পাশাপাশি এ কাজের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

শতভাগ নিয়ম মেনেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রশ্নই ওঠে না। আর নগর উন্নয়ন কমিটির সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আবদুর রহমান, রাজউকের তৎকালীন (২০১৮-১৯) চেয়ারম্যান

মোবাশ্বের হোসেন আরও বলেন, খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে প্লটগুলো রূপান্তরের অনুমোদন দিয়েছে রাজউক, যার পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। এ জন্য ওই সময়ে রাজউকের দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যানকে তলব করে জানা উচিত কোন স্বার্থে তিনি এ কাজ করছেন।

ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণ করা হয় ২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণবিধি অনুসারে। গুলশান ও বনানীতে আবাসিক প্লটে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চতা পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে প্লটমালিক উদ্যোগী হয়ে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে আবাসিক প্লট বাণিজ্যিকে রূপান্তর করতে পারবেন। তবে ভবনের উচ্চতার ক্ষেত্রে আবাসিক প্লটে যে উচ্চতা পাওয়া যেত, সেটিই পাওয়া যাবে।

কিন্তু এই বিধি না মেনে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে রাজউকের বোর্ড সভায় গুলশানে ১৪টি এবং বনানীতে ১টি প্লটে উচ্চতার কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। দুই বছরে মোট নয়টি বোর্ড সভায় এসব অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে আটটি সভায় সভাপতিত্ব করেন রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান ও একটিতে সংস্থাটির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ।

নগর উন্নয়ন কমিটির প্রধান হলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব। আর রাজউকের চেয়ারম্যান এই কমিটির সদস্য। আবাসিক প্লট বাণিজ্যিকে রূপান্তরের পর সেখানে নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চতা দেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে একাধিক সভা করেছে কমিটি। সভায় অধিকাংশ সদস্য রাজউকের সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে এ–সংক্রান্ত নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত হয়েছে, ভবিষ্যতে নগর উন্নয়ন কমিটির সম্মতি ছাড়া ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চতার অনুমোদন দেবে না রাজউক।

অনিয়মের তদন্ত হয়নি

গত মাসে অনুষ্ঠিত নগর উন্নয়ন কমিটির সর্বশেষ সভায় রাজউকের ওই অনুমোদন নিয়ে কেউ কেউ অনিয়মের সন্দেহ প্রকাশ করেন। সভা সূত্রে জানা গেছে, এর ভিত্তিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি হয়েছিল ২০১৯ সালের শেষ দিকে। কমিটির দায়িত্ব ছিল ওই ১৫ প্লটের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চতা দেওয়ার বেলায় বিধিবিধান অনুসরণ করা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল কমিটিকে। কিন্তু এখনো প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কমিটি কোনো কাজ করেনি। কমিটির আরও দুজন সদস্যের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা মনেই করতে পারেননি, তাঁরা সদস্য ছিলেন।

প্লট রূপান্তরের কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, জানতে চাইলে রাজউকের তৎকালীন (২০১৮-১৯) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শতভাগ নিয়ম মেনেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রশ্নই ওঠে না। আর নগর উন্নয়ন কমিটির সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।