ফার্মগেটের জাবায় মিলবে গারোদের খাবার

জাবা রেস্তোরাঁর খাবার
ছবি: জাবার সৌজন্যে

বসার জন্য রয়েছে বাঁশ–বেত দিয়ে তৈরি মোড়া ও চেয়ার–টেবিল। অন্দরসজ্জায় ব্যবহার করা হয়েছে নানা তৈজসপত্র। আছে গারো নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক দকমান্দাও। দেয়ালে ঝোলানো ছবিতে ঘন শালবনের দৃশ্য। কোনো কোনো ছবিতে গারো গ্রামের মানুষের কর্মব্যস্ততার চিত্র স্পষ্ট। এটি একটি রেস্তোরাঁ, নাম ‘জাবা’। গারোদের আচিক ভাষায় এর অর্থ তরকারি। রাজধানীর মানুষকে গারোদের খাবারের সঙ্গে পরিচয় করাতেই সম্প্রতি চালু হয়েছে এটি।

বাংলাদেশের মাতৃসূত্রীয় জাতি গারো বা মান্দি। টাঙ্গাইলের মধুপুরে সবচেয়ে বেশি গারোর বাস। এ ছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট ও সুনামগঞ্জেও গারোদের বসবাস আছে। রাজধানীতে পাহাড়ের বিভিন্ন জাতিসত্তার খাবারের দোকান থাকলেও গারোদের খাবারের রেস্তোরাঁ এটিই প্রথম। গারোদের খাবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এতে তেল ও মসলার ব্যবহার খুব কম। জাবায় যেসব খাবার বেশি চলে, সেগুলোর প্রায় সবই তেল ও মসলামুক্ত।

এ রেস্তোরাঁর মালিক সুমন নংমিন বলছিলেন, ‘এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের বেশির ভাগ তেল–মসলা ছাড়া খাবার চান। মাছ, মাংস, সবজি—সবকিছু্ই প্রায় তেল–মসলা ছাড়া রান্না করার পদ্ধতি আছে আমাদের।’

কলাপাতায় মোড়ানো তেল–মসলাবিহীন ছোট মাছের এমন একটি পদের নাম, ‘নাথক গপ্পা’। আছে মুরগির পদ ‘দ গপ্পা’। এসবই ভাপে সেদ্ধ করা হয়।

চিকেন–মাশরুম গপ্পা

‘বিভিন্ন চালের ভাতের সঙ্গে এ দুই পদ দারুণ জমে,’ এমন মন্তব্য রেস্তোরাঁয় আসা জয়নাল আবেদীনের। সম্প্রতি এক দুপুরে গিয়ে দেখা হলো তাঁর সঙ্গে। বন্ধু এসেছেন বিদেশ থেকে। তাঁকে নিয়ে খেতে এসেছেন। জয়নালের মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী বন্ধু রুবেল আহমেদও খুশি খাবার খেয়ে। তিনি বললেন, ‘খাবারে একটু ঝাল বেশি। কিন্তু ভিন্ন স্বাদ। বেশ লাগল।’

রাজধানীর ফার্মগেটে সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে একটু পশ্চিম দিকে এগোলে ডান দিকের ১০তলা ভবনের চতুর্থ তলায় জাবা রেস্তোঁরা। এটি একটি বাণিজ্যিক ভবন। নানা ধরনের অফিস ভবনে। এর মধ্যে ৫০০ বর্গফুটের ‘ছোট শালবনে’ গারো খাবারের পসরা। চালু হয়েছে এপ্রিল থেকে। করোনার কারণে বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় এখন বেশ চলছে, জানান এ রেস্তোরাঁর কর্মী পায়েল নকরেক।

সেদ্ধ করে তৈরি খাবারগুলোকে গারো ভাষায় বলে গপ্পা। আছে মুরগির গপ্পা, মাছের গপ্পা। হাঁসের মাংসের এক অভিনব পদ ‘মিয়া ফুরা’। বাঁশের কোড়ল ও চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয় এ খাবার।

জাবায় মেলে গারোদের পিঠা

এখানে যেসব খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে, এর বড় অংশ আসছে গ্রাম থেকে। গারোদের খাবারের সত্যিকারের স্বাদ দিতে চায় রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ। এভাবেই তারা তুলে ধরতে চায় বননির্ভর এ জাতির সমৃদ্ধ সংস্কৃতি।

সুমন নংমিন বলছিলেন, ‘আমার দাদি ও মায়ের হাতে ছোটবেলায় যেসব খাবার খেয়েছি, তার অনেক খাবারের চল এখন গারো সমাজেও নেই। আমি সেই পুরোনো খাবারগুলো নগরবাসীকে খাওয়াতে চাই।’

রেস্তোরাঁর পাচক সঞ্জু সাংমা ভারতের গোয়ায় একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেছেন। সঞ্জু জানান, গারোদের খাবারের সঠিক স্বাদ দেওয়ার জন্য এখানে অনেক পদ রান্না হয় কয়লার আগুনে।

জাবা রেস্তোরাঁ

রেস্তোরাঁর ভাত, মাছ, মাংসের বাঙালি খাবারও মেলে। তবে এখানে যাঁরা আসছেন, তাঁরা প্রায় সবাই গারোদের খাবারই খেতে চান বলে জানান পায়েল।
রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়ায় কয়েকটি রেস্তোরাঁ আছে, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তার খাবার মেলে। কিন্তু গারোদের খাবারের কোনো রেস্তোরাঁ এর আগে ছিল না।

পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোর বিভিন্ন রান্নার রীতির সঙ্গে গারোদের খাবারের মিল আছে। যেমন পাহাড়িদের মতোই গারোদের মধ্যে ভাপে বা সেদ্ধ করে খাবারের রীতি আছে। বাঁশের মধ্যে পুরে মাছ, মাংস বা অন্য তরকারি রান্না করে পাহাড়িরা। জাবাতেও আপনি এই খাবারের স্বাদ পাবেন।

রান্নার জন্য সাজিয়ে রাখা গ্রাম থেকে আনা কলার মোচা, পেঁপে ফুল, বাঁশের কোড়ল

দুপুর রাতের খাবারের পাশাপাশি আছে নাশতার নানা সামগ্রী। আছে নানা ধরনের পানীয়। বিভিন্ন ফলের রস, বেল–চা, তেঁতুল–চা বেশ জনপ্রিয়। আছে গারোদের বাহারি পিঠা। সন্ধ্যেবেলায় প্রায় আরণ্যক পরিবেশে, কাচঘেরা ঘরটিতে বাজতে থাকে গারোদের গান। তখন গরম পিঠায় কামড় দিতে মন্দ লাগার কথা নয়।

জাবার এসব খাবার ঘরে বসেও পেতে পারেন। এখানে অর্ডার দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। গারোদের নানা তৈজসপত্র এখান থেকে বিক্রির পরিকল্পনা আছে রেস্তোরাঁর কর্তৃপক্ষের।