অটিজমে আক্রান্ত শিশু আশফাক আহমেদ আবির (১৩) ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। গত বছরের অক্টোবর থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে শুরু হওয়া ভাতা ডিজিটাইজেশনের প্রক্রিয়ায় সে–ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে ডিজিটাইজেশনের পরে দীর্ঘদিন ধরে ভাতার বিষয়ে কোনো খোঁজখবর না পেয়ে শিশু আশফাকের বাবা আনোয়ার হোসেন স্থানীয় সমাজসেবা কার্যালয়ে যান। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে মুঠোফোন নম্বর দেওয়ার পর তিনি কম্পিউটার দেখে জানান, তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা তোলা হয়ে গেছে।
আনোয়ার হোসেন রাজধানীর হাজারীবাগের ভাগলপুর লেনের ২২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। প্রথম আলোকে জানালেন, তাঁর ছেলে মাসে প্রতিবন্ধী ভাতা পায় ৭৫০ টাকা করে। একবারে তিন মাসের ভাতা দেওয়া হতো। ডিজিটাইজেশনের আগে তিনি সোনালী ব্যাংকের ট্যানারি মোড় শাখা থেকে ভাতার টাকা তুলতেন। তিনি বলেন, ভাতার টাকা নেওয়ার জন্য গত বছরের অক্টোবরে সমাজসেবার আজিমপুর শাখা থেকে তাঁকে ডেকে নেওয়া হয়। মুঠোফোনে অর্থ লেনদেন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ–এ তাঁর একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়। তাঁকে একটি পিন নম্বর দেওয়া হয় এবং জানানো হয়, ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া শেষে ভাতা অ্যাকাউন্টে এলে তিনি মুঠোফোনে বার্তা পাবেন।
তবে দীর্ঘ সময়েও টাকা আসার কোনো খোঁজ না পেয়ে তিনি এ বছরের অক্টোবরে সেই কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মুঠোফোন নম্বরটি নিয়ে কম্পিউটারে মিলিয়ে দেখে জানান, তাঁর অ্যাকাউন্টে ৯ মাসের ভাতার ৬ হাজার ৭৫০ টাকা পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। বাকিটা অ্যাকাউন্টে রয়েছে।
আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, কেউ একজন টাকাটা তুলে নিয়ে গেছে। পরে ওই কর্মকর্তার পরামর্শে পিন নম্বর পাল্টে তিনি বাকি টাকাটা তুলে নেন। ওই এলাকার আরও দুই প্রতিবন্ধী শিশুর ছয় মাসের ভাতা নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে। আরেক শিশুর ভাতা অন্য একজনের মুঠোফোন নম্বরে চলে গেছে। ভাতা ফেরত চেয়ে ওই শিশুদের অভিভাবকেরা কয়েক দফা সমাজসেবা কার্যালয়ে যোগাযোগ করলেও কোনো প্রতিকার পাননি।
ভাতা যাচ্ছে নগদ ও বিকাশ অ্যাকাউন্টে
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি ভাতাভোগীর মোট সংখ্যা ৮৮ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে ২১ জেলার ৭৭টি উপজেলার ১২ লাখ ৫০ হাজার ভাতাভোগীকে ২০১৭-১৮ সালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের (ব্যাংক এশিয়া, মধুমতি ব্যাংক লিমিটেড ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক) মাধ্যমে ভাতা দেওয়া শুরু হয়। গত বছরের অক্টোবর থেকে ৪৯৫টি উপজেলায় জিটুপি পদ্ধতিতে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে ৭৬ লাখ ভাতাভোগীর অ্যাকাউন্ট ডিজিটাইজেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভাতাভোগীদের তথ্যভান্ডার করা হয়। মুঠোফোনে অর্থ লেনদেন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে দেশজুড়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। নগদ ৭৫ শতাংশ এবং বিকাশ ২৫ শতাংশ ভাতাভোগীকে মুঠোফোন অ্যাকাউন্টে ভাতা পৌঁছে দিচ্ছে। নতুন তালিকা ধরে এ বছরের ৩০ জুন থেকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি দেওয়া শুরু হয়। দুই কিস্তিতে জিটুপি (গভর্নমেন্ট টু পারসন) পদ্ধতিতে ভাতাভোগীর মুঠোফোনের ডিজিটাল অ্যাকাউন্টে ৯ মাসের বকেয়া ভাতা দেওয়া শুরু হয়।
‘অন্য কেউ’ তুলে নিয়েছে ফাহমিদা ও ইয়াসিনের ভাতা
হাজারীবাগের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ফাহমিদা আক্তার (১৪) প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি পায়। বাবা আবুল কাশেম মারা গেছেন। সংসারে রয়েছেন মা ফারহানা আক্তার এবং কবি নজরুল সরকারি কলেজে সম্মান চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী বড় ভাই মোহাম্মদ ফাহিম। ভাই ফাহিম প্রথম আলোকে বলেন, নগদ উদ্যোক্তা একজনের কাছ থেকে ভাতার টাকা তুলতে গিয়ে জানতে পারেন, টাকা জমা হলেও অ্যাকাউন্টে নেই। পরে নগদ অ্যাকাউন্টের লেনদেনের তথ্য থেকে জানতে পারেন, ‘কেউ একজন’ সাড়ে চার হাজার টাকা তুলে নিয়েছে। সেই নম্বরে ফোন করলে বন্ধ পাওয়া যায়।
রাজধানীর ইসলামবাগের বাসিন্দা রুমা আক্তার ও মো. বাবুল ফকির দম্পতির দুই ছেলে–মেয়েই প্রতিবন্ধী। ১২ বছরের মেয়ে বাবলী আক্তার প্রতিবন্ধী ভাতা পায় এবং সাত বছরের ছেলে ইয়াসিন প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি পায়। দুজনই নবাবগঞ্জে প্রতিবন্ধীদের স্কুল বাংলাদেশ শিশুকল্যাণ পরিষদে পড়ে।
মা রুমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, দুই সন্তানের জন্য তাঁরা দুটি নগদ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছেন। বাবলীর নম্বরে তিন দফায় ৯ হাজার টাকা ভাতা পেয়েছেন। তবে ইয়াসিনের ছয় মাসের সাড়ে ৪ হাজার টাকা ভাতা অন্য কেউ তুলে নিয়েছে। যে নম্বর থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে, সেই নম্বরে ফোন করে বন্ধ পাচ্ছেন। রুমা বলেন, একাধিকবার সমাজসেবা কার্যালয়ে যোগাযোগ করেও টাকা উদ্ধারের বিষয়ে কিছু জানতে পারেননি।
কাব্যের ভাতা অন্যের অ্যাকাউন্টে
আরেক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু কাব্য রায়ের মা ঋতু দত্ত প্রথম আলোকে জানান, তাঁর ছেলের ছয় মাসের ভাতা অন্য একটি মুঠোফোন নম্বরে চলে গেছে। তাঁর ছেলে ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। ডিজিটাইজেশনের আগে সোনালী ব্যাংকের হাজারীবাগ শাখা থেকে ভাতার টাকা তুলতেন। গত বছরের অক্টোবর থেকে এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ছয় মাসের সাড়ে চার হাজার টাকার খোঁজ নেই। সমাজসেবা কার্যালয়ে যাওয়ার পর তাঁরা কম্পিউটার দেখে জানান, ঋতু দত্তের মুঠোফোন নম্বরের শেষ তিন ডিজিট ৩৪৯–এর জায়গায় ৩০৯–এ টাকা চলে গেছে। যে নম্বরে টাকা চলে গেছে, সেখানে ফোন করে জানা যায়, ওটা একজন নারীর নম্বর এবং তিনি পটুয়াখালীতে থাকেন। ওই নারীকে সমাজসেবা কার্যালয় থেকে বলা হয়, আপনি প্রতিবন্ধী শিশুর ভাতা তুলে নিলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। তখন ওই নারী জানান, তাঁর নগদ অ্যাকাউন্টই নেই, তিনি কীভাবে টাকা তুলবেন! এরপর ওই নারীকে এই টাকা সমাজসেবা কার্যালয় ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তাঁকে নগদ অ্যাকাউন্ট খুলতে নিষেধ করা হয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তর ও নগদ যা বলছে
নগদ–এর জনসংযোগ বিভাগের প্রধান জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নগদ বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুঠোফোনে আর্থিক সেবা দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কোনো গ্রাহক যদি তাঁর ব্যক্তিগত পোপন পিন নম্বর অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার না করেন, তাহলে কারও পক্ষে কোনো অবস্থায় টাকা ক্যাশ-আউট করা সম্ভব নয়। যে সংস্থা বা দপ্তর ভাতা, অনুদান, উপবৃত্তি বা যেকোনো অর্থ বিতরণ করুক না কেন, নগদ-এর কাছে নম্বরের তালিকা দিলে সে অনুসারেই কেবল অর্থ বিতরণ করা হয়। নগদ এ ক্ষেত্রে নিজে থেকে কোনো তালিকা করে না। ফলে একজনের জায়গায় অন্যজনের কাছে ভাতা বা অনুদান চলে গেলে সেটি নগদ-এর পক্ষে জানা বা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
প্রতিটি অভিযোগের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা শাখার পরিচালক মো. সাব্বির ইমাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যে প্রতিবন্ধী শিশুদের ভাতা নিয়ে সমস্যা হয়েছে, তা অবশ্যই ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা নেবে অধিদপ্তর। তাঁরা স্থানীয় সমাজসেবা কার্যালয়ে অভিযোগ করলে তা খতিয়ে দেখা হবে।
ভাতার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনার অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায় বলে জানালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, নগদ ও বিকাশের মাধ্যমে ভাতার টাকা দেওয়া হচ্ছে দেশজুড়ে। ভাতাভোগীদের বেশির ভাগই দরিদ্র ও স্বল্প শিক্ষিত হওয়ায় তাঁদের মধ্যে সচেতনতা কম। তাঁদের অনেকে নগদ বা বিকাশ অ্যাকাউন্টের পিন নম্বর অন্যদের জানিয়ে দেন। অর্ধেক ভাতাভোগীরই নিজের মুঠোফোন নেই, তাঁরা অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য অন্যদের নম্বর দেন। এ কারণে কোনো গোপনীয়তা থাকে না।