>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com
গত ২০ মার্চ থেকে বাসায় অবরুদ্ধ আছি। আমার পুরো জীবনে পৃথিবীব্যাপী এমন বিয়োগান্ত পরিস্থিতি আর দেখিনি। ৩১ মে হঠাৎ আমার নিজের পরিবারে নেমে এল শোকের ছায়া। আমার সন্তানতুল্য ভাশুরের ছেলে সেদিন ভোর পাঁচটায় ঢাকার একটি হাসপাতালে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেল।
৪২ বছর বয়সী এই ছেলেটির মৃত্যুতে নিজেদের অসহায়ত্ব খুব কাছে থেকে দেখলাম। দুটি শিশুসন্তান, স্ত্রী আর মাকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ও চলে গেল। এই অল্প বয়সেও কুমিল্লার দেবীদ্বারে ওদের ভিরাল্লা নামের গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য কত কী না করেছে সে। স্কুল গড়তে, মসজিদ তৈরি করতে, মানুষের বিপদে–আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত আগ বাড়িয়ে। ওর মৃত্যুর সার্থকতা এটুকুই যে এতটা অল্প বয়সেও ও অনেক ভালো কাজের স্বাক্ষর রেখে গেছে।
ওর মৃত্যুটা মোটেই মেনে নিতে পারছি না। বেঁচে থাকলে আরও কত দুঃখী মানুষ উপকৃত হতো। পরিচিত-অপরিচিত অনেকের হৃদয় চুরি করে ও যেন পালিয়ে গেল। হয়তো একদিন টিকা আবিষ্কৃত হবে, ওষুধ বের হবে, মানুষ করোনাকে জয় করবে। আমরা সেদিনের অপেক্ষায় আশা নিয়ে বেঁচে থাকব।
প্রকৃতির মধ্যেই শুধু কিছুটা সান্ত্বনা মেলে। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছি, প্রকৃতি উদার হস্তে নিজেকে মেলে ধরেছে। কোনো দীনতা সেখানে নেই। জানালার গরাদ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, অক্লান্তভাবে সে রূপ পাল্টে চলেছে। আকাশ কখনো পরিষ্কার নীল, কখনো মেঘের স্তূপে ভরা, আবার কখনো ঘন কালো মেঘ চারদিক আচ্ছন্ন করে বৃষ্টি নামিয়ে আনছে। দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছি, কৃষ্ণচূড়াগাছটা ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে। শিমুল আর পলাশ ঝরছে। আমগাছের শাখায় শাখায় আম। পশ্চিমের জানালায় নিমগাছটাতে ছোট ছোট সাদা ফুল মিষ্টি সুরভি ছড়াচ্ছে। এরই মধ্যে বেগুনি রঙের জারুল ফুল ফুটতে শুরু করেছে।
ভালো নেই কেবল মানুষ। এরই মধ্যে বাংলা নববর্ষ, রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী, পবিত্র ঈদুল ফিতর, বৌদ্ধপূর্ণিমা, নজরুল জন্মজয়ন্তীর মতো বিশেষ দিনগুলো পার হয়ে গেল। আমরা সমবেত হয়ে খোলা গলায় কোনো গান গাইতে পারলাম না। চলে গেলেন ড. আনিসুজ্জামান আর জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্ব। অন্য সময়ে এঁদের শেষযাত্রায় লাখো মানুষের ঢল নামত রাজপথে। তাঁরাও বিদায় নিলেন নীরবে–নিভৃতে।
আমরা নাকি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব! আমাদের অহং এত বড় হয়ে উঠেছিল যে প্রকৃতিকে উজাড় করতে বসেছিলাম। এর কঠিন মূল্য এখন কড়ায়-গন্ডায় শোধ করতে হচ্ছে। প্রকৃতি উচ্ছেদ করে আমরা বসাতে চেয়েছি কলকারখানা। এখন খোদ মানুষই উচ্ছেদ হতে বসেছে। ইট–কাঠ–পাথরের সভ্যতার মধ্যেও যে ক্ষুদ্র তৃণলতাটিকে বেড়ে উঠতে দিতে হয়, প্রজাপতি আর ফড়িংকে রঙিন ডানায় ওড়ার অবকাশ রেখে দিতে হয়—তার তোয়াক্কা আমরা করিনি। মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের কথা:
কে বড়, কে ছোট
কার হলো জয়, কার পরাজয়
কাহার বৃদ্ধি, কার হলো ক্ষয়?
আমরা ভুল করেছি। আমাদের সন্তানেরা নিশ্চয়ই তার সংশোধন করবে। আমরা ইরাকের ধ্বংসস্তূপ দেখতে চাই না, আমরা সিরিয়ার যুদ্ধ চাই না, ইয়েমেনের বর্বরতা চাই না, মিয়ানমারের ভিন্ন ধর্মের মানুষ নিধন চাই না, সমুদ্রসৈকতে শিশুর নিথর দেহ দেখতে চাই না, কালো হওয়ার অপরাধে কারও মৃত্যু দেখতে চাই না।
যুগ যুগ ধরে কত না সাহিত্যিক, গবেষক, বিজ্ঞানী, নিসর্গী, মানবাধিকারকর্মী, ধর্মবেত্তাদের চিন্তার অমিয়ধারা মানবজাতির ওপরে বর্ষিত হয়েছে। আমরা কি শুধু তাঁদের নামই জপে যাব? তাঁদের কথায় কান পাতব না?
মানবধর্মের জয় হোক। নতুন আনন্দে ভাসুক পৃথিবী।