‘আমি ভালো আছি। ডাক্তার স্যারও বলছে আমি ভালো হয়ে গেছি।’ খুশি খুশি গলায় কথাগুলো বলছিল নূপুর। এই নূপুর আগে খেলতে গিয়েও হাঁপিয়ে যেত। মা বুকে নিলেও মেয়ে বলত, তার খারাপ লাগছে। রাজধানীর জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এমআইসিএস (মিনিমালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি) বা কাটাছেঁড়া ছাড়া প্রথম নূপুরের হৃদ্যন্ত্রে অস্ত্রোপচার করা হয়। তার হৃদ্যন্ত্রে ছিদ্র ছিল। ২০১৯ সালের আগস্টে পাবনার এই কিশোরীর অস্ত্রোপচার করা হয়। গতকাল সোমবার কথা হয় নূপুরের সঙ্গে। ভালো আছে নূপুর।
নূপুরের পর মুঠোফোনে কথা বলেন তার মা আনজু। তিনি বললেন, ‘সবার দোয়ায় মেয়ে এখন ভালো আছে। কোনো ওষুধও আর খাইতে হয় না। মেয়ে তো ঢাকার স্যারদের মতন ডাক্তার হইতে চায়। গত বছর মেয়ের জন্মদিনে ঢাকা থেকে স্যারেরা মেয়ের জন্য কেকও পাঠাইছে।’
অস্ত্রোপচারের পরে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম নূপুরকে নিয়ে ভিডিও প্রতিবেদন করেছে। আর ইউটিউবে নূপুরের সেই ভিডিও দেখে অনেকেই সরকারি ওই হাসপাতালে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য।
গত ২৫ মে এই হাসপাতালেই ময়মনসিংহের হাসিনা বেগমের অস্ত্রোপচার হয়। তিন সন্তানের জননী হাসিনা। দেশে প্রথমবারের মতো ২ থেকে ৩ ইঞ্চি ফুটো করে এমআইসিএস পদ্ধতিতে হাসিনার হার্টের ডাবল ভাল্ভ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তিনিও এখন ভালো আছেন। তবে এখনো শরীরে একটু ব্যথা আছে।
জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মিনিমালি ইনটেনসিভ কার্ডিয়াক সার্জন আশরাফুল হক সিয়ামের নেতৃত্বে এমআইসিএস পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচারে নূপুর-হাসিনাদের মুখে হাসি ফুটেছে। হাসিনা হাসতে হাসতে বললেন, ‘পদ্ধতিটা ভিন্ন, কিন্তু অস্ত্রোপচার তো করতে হয়েছে। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে প্রায় পুরো বুকের হাড় কেটে তারপর অস্ত্রোপচার করতে হতো। আর নতুন পদ্ধতিতে চামড়া ও মাংস কেটে ছোট ছিদ্র করে ভেতরের অস্ত্রোপচার করতে হয়। তাই রোগীর একটু ব্যথা তো হতেই পারে।’
চিকিৎসক আশরাফুল হক বললেন, এমআইসিএসে পুরো বুক ফাঁকা না করে, পাঁজরের হাড় না কেটে শুধু ছিদ্র করে অস্ত্রোপচারটি করা হয়। এই অস্ত্রোপচারে রক্তক্ষরণ কম হয়। বুকে বড় দাগ থাকে না। অস্ত্রোপচারের এক থেকে দুই দিন পর থেকেই রোগী স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারে।
২৫ মে হাসিনার অস্ত্রোপচার হয়। ৩০ মে চিকিৎসকদের বিশেষ অনুমতিতে হাসপাতালটির কার্ডিয়াক আইসিইউতে গিয়ে দেখা যায়, হাসিনা বিছানায় বসে আছেন। বিছানার চারপাশে জটিল যন্ত্রপাতির কোনো অস্তিত্ব নেই। চিকিৎসক আশরাফুল হকের সঙ্গে হাঁটলেন, চিকিৎসকের সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণ শরীরচর্চাও করলেন।
হাসিনা প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় তিন বছর ধরে সংসারের তেমন কোনো কাজ করতে পারেন না। স্বামী রান্না করেছেন। দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে মেয়ের বয়স এখনো দুই বছর হয়নি। অস্ত্রোপচারের আগে রক্তশূন্যতাসহ নানান জটিলতায় দুই মাস হাসপাতালেই ভর্তি থাকতে হয়েছে। তবে অস্ত্রোপচারের পর তিনি ভালো আছেন।
হাসিনা বলেন, এই অস্ত্রোপচারের চেয়ে সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য যে সিজার করতে হয়েছিল, তখন বেশি কষ্ট হয়েছিল। সিজারের পর তো অনেক দিন হাঁটতেই পারেননি। আর এবার অস্ত্রোপচারের পরদিন থেকেই তিনি একা হাঁটতে পারছেন।
জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক আইসিইউ ইনচার্জ বনানী মণ্ডল জানান, বুক কেটে অস্ত্রোপচার করার জন্য অনেক নারীর বিয়ে হয় না, বিবাহিত থাকলে সংসার টেকে না, এমন উদাহরণ রয়েছে। পাশাপাশি নারীর মানসিক ট্রমা তো থাকেই। এমআইসিএস পদ্ধতিটি নারীদের এসব সামাজিক সমস্যা থেকেও মুক্তি দিচ্ছে।
নূপুর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এমআইসিএস পদ্ধতিতে প্রায় ৫০ জনের অস্ত্রোপচার হয়েছে (করোনার কারণে প্রায় ছয় মাস বন্ধ ছিল)। চিকিৎসকেরা জানালেন, এর মধ্যে ঢাকার বাইরে থেকে চিকিৎসা নিতে আসা নারীদের সংখ্যাই বেশি। কুমিল্লার শাহেনা আক্তার ও টাঙ্গাইলের ইশরাত জাহান বীণার ভাল্ভের সমস্যা ছিল। বুক কেটে অস্ত্রোপচার করা নিয়ে ভয় ছিল তাঁদের। বর্তমানে এই নারীরাও হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছেন।
২৪ বছর বয়সী টাঙ্গাইলের ইশরাত জাহান বীণা ৬ জুন হাসপাতালে এসেছিলেন ফলোআপের জন্য। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে বীণার সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। অস্ত্রোপচারের পর যখন তিনি বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর খাওয়ার রুচি ছিল না। শরীরের হাড়গুলোও যেন গোনা যাচ্ছিল। তবে হাসতে হাসতেই বলেছিলেন, অস্ত্রোপচারের পর থেকে তাঁর মুখের রুচি বেড়ে গেছে, যা খাচ্ছেন সবই মজা লাগছে।
গত বছরের অক্টোবর মাসে রাজধানীর বেসরকারি ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালে এমআইসিএস পদ্ধতিতে কুষ্টিয়ার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শিপ্রা পালের অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এতেও নেতৃত্ব দেন জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক আশরাফুল হক।
টাঙ্গাইলের ইশরাত জাহান বীণার আর কোনো ভাইবোন নেই। মানসিকভাবে অসুস্থ তাঁর বাবা কিছু করেন না। বীণা থাকেন দাদার কাছে। এলাকার চেয়ারম্যানসহ গণমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় বীণার চিকিৎসা হয়। হাসপাতাল থেকে বিনা মূল্যে ভাল্ভ পেয়েছিলেন। ফলে তাঁর চিকিৎসার খরচ ছিল অনেক কম।
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া নূপুরের বাবা মিজানুর মোল্লা কাপড়ের ব্যবসা করেন। দুই ছেলে বিয়ে করেছেন। জন্মগতভাবেই নূপুরের হৃদ্যন্ত্রে বিভিন্ন সমস্যা ছিল। নূপুরের চিকিৎসায় খরচ করতে হয়েছে অনেক টাকা। মা আনজু জানালেন, জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে থাকা-খাওয়াসহ নূপুরের চিকিৎসায় খরচ হয়েছে দুই লাখ টাকার বেশি।
হাসিনার স্বামী আমিনুল হক স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর উত্তরায় বোনের বাসায় আছেন। স্ত্রীকে ফলোআপ করিয়ে একবারে বাড়ি ফিরবেন। এই দম্পতির এক ছেলে কোরআনে হাফেজ ও আরেক ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ের বয়স প্রায় দুই বছর। মেয়ে থাকছে তার খালার কাছে।
আমিনুল হক জানালেন, হাসিনার অস্ত্রোপচারের আগে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দুই মাস হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছে। গত ৩১ মে হাসিনা হাসপাতাল থেকে ছুটি পান। আমিনুল হক ব্যবসা করেন। তবে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তেমনভাবে ব্যবসায় সময় দিতে পারছেন না। ঋণ করেছেন। হাসপাতালে দুই মাসের থাকা-খাওয়ার হিসাব ছাড়াই খরচ হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। আমিনুল হক জানালেন, বিনা মূল্যে হাসপাতালের বিছানা ও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু অস্ত্রোপচারের জন্য অক্সিজেন মেশিন, বিভিন্ন ওষুধ এবং দুটি ভাল্ভ কিনতে হয়। পরে অবশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি ভাল্ভের মূল্য হিসেবে ৫০ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছে। এটা তাঁর জন্য অনেক স্বস্তির বিষয়।
আমিনুল হক বললেন, ‘স্ত্রীকে নিয়ে ভারতেও যাইতে চাইছিলাম। সেইখানে খরচ আরও বেশি। তাই দেশেই চিকিৎসা করানোর জন্য মনস্থির করি। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে অনেক ভোগান্তি ও টাকা খরচও হইছে। অবশেষে স্ত্রীর অপারেশন হইছে। এখন স্ত্রী সম্পূর্ণ ভালো থাকলেই হইল। আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খরচটা কমানোর চেষ্টা করলে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষগুলোর জন্য একটু ভালো হইত।’
সরকারি হাসপাতালে এমআইসিএসের মতো আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতিতে নেতৃত্ব দেওয়া আশরাফুল হক বললেন, সরকারি হাসপাতালে ওষুধ, ভাল্ভসহ বিভিন্ন সরঞ্জামের সাপ্লাই থাকলে তখন রোগীদের চিকিৎসার খরচ অনেক কমে যায়। তবে বিভিন্ন সময় সাপ্লাই না থাকলে রোগীদের বিভিন্ন জিনিস কিনতে হয়। আর রোগীর স্বজনেরা হাসপাতালে থাকা-খাওয়াসহ নানা খরচ একসঙ্গে হিসাবে ধরেন বলে খরচটাও অনেক বেশি মনে হয়। বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিটির প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে, তাই খরচ কমানোর বিষয়টি কর্তৃপক্ষ অবশ্যই বিবেচনায় রাখবে।
‘সবার দোয়ায় মেয়ে এখন ভালো আছে। কোনো ওষুধও আর খাইতে হয় না। মেয়ে তো ঢাকার স্যারদের মতন ডাক্তার হইতে চায়। গত বছর মেয়ের জন্মদিনে ঢাকা থেকে স্যারেরা মেয়ের জন্য কেকও পাঠাইছে।’নূপুরের মা আনজু
নূপুর, হাসিনারা যখন হাসিমুখে বাড়ি ফেরেন, সেই আনন্দকে ঈদের আনন্দের সঙ্গে তুলনা করলেন আশরাফুল হক। বললেন, আধুনিক পদ্ধতিটির যেমন সুবিধা আছে, তেমন অসুবিধাও আছে। সার্জনকে দক্ষ হতে হয়। লোকবল, সময় ও মনোযোগ বেশি লাগে। তবে নূপুর থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে এখন পর্যন্ত যতগুলো অস্ত্রোপচার হয়েছে, তা শতভাগ সফল হয়েছে। হাসিনাদের মতো রোগীদের তাই চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার আগে আরেকবার ভাবা উচিত বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। তাঁর আশা, এমন সময় বেশি দেরি নয় যখন বিদেশিরাও এই সেবা নিতে বাংলাদেশে আসবেন।