রাজধানীর আসাদ অ্যাভিনিউ ও সাতমসজিদের ডি-টাইপ কলোনিতে ৪৩০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।
যুগ্ম সচিব শওকত আলীর বরাদ্দ নেওয়া ১ হাজার ৮৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
নিয়ম ভেঙে ফ্ল্যাট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগ আরও তিন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শওকত আলী। সাত বছর আগে রাজধানীর মিরপুরে সরকারি এক আবাসন প্রকল্পে একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ পান তিনি। নিয়ম অনুযায়ী, তিনি সরকারের অন্য প্রকল্প থেকে আর ফ্ল্যাট পাবেন না। তবে অভিযোগ উঠেছে, প্রভাব খাটিয়ে আরেক প্রকল্পের ফ্ল্যাটও কোটি টাকায় নিয়েছেন তিনি।
শওকত আলী একাই নন, সরকারি প্রকল্পের ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেতে আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর হাউজিং এস্টেটের আসাদ অ্যাভিনিউ ও সাতমসজিদ রোডে অবস্থিত ডি-টাইপ কলোনিতে ৪৩০টি ফ্ল্যাট নির্মাণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। নিয়ম ভেঙে এখানেই ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছেন শওকত আলী। ১ হাজার ৮৫০ বর্গফুটের এ ফ্ল্যাটের দাম ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, ওই প্রকল্পের ফ্ল্যাট বরাদ্দে সরকারি কর্মকর্তা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, অনাবাসী বাংলাদেশিসহ মোট ১৭টি কোটা ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ ৩২টি ফ্ল্যাট। গত ফেব্রুয়ারিতে তাড়াহুড়া করে এই কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত এসব ফ্ল্যাটের বরাদ্দপত্র দেওয়া হয়েছে। যদিও অন্যান্য কোটায় ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য এখনো লটারি হয়নি। তবে জামানত হিসেবে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। প্রায় তিন একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। তবে মামলা জটিলতায় কাজ এখনো শুরু হয়নি।
প্রকল্পের শর্ত ছিল, আবেদনকারী যদি নিজের বা তাঁর স্ত্রী–স্বামী কিংবা সন্তানের নামে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, রাজউক, অন্য কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, তবে তিনি মোহাম্মদপুরের এ প্রকল্পে ফ্ল্যাট কেনার আবেদন করতে পারবেন না। ইতিপূর্বে বরাদ্দ পাওয়া কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট বিক্রি বা হস্তান্তর করে থাকলেও তিনি প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন বলে গণ্য হবেন। নিয়ম ভেঙে প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলে বরাদ্দের সেই আদেশ বাতিল করা হবে। সেই সঙ্গে ক্রেতার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হবে।
তবে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেননি শওকত আলী। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকারি এই কর্মকর্তা ২০১৫ সালে গৃহায়ণের আরেকটি আবাসন প্রকল্পে (জয়নগর প্রকল্প) ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পেয়েছেন। মিরপুর ১৫ নম্বর সেকশনে ১৪ তলার এ প্রকল্পে ৫২০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটির ৫ নম্বর ভবনের জি–২ নম্বর ফ্ল্যাটটি ৬৮ লাখ ১০ হাজার টাকায় শওকত আলী বরাদ্দ পেয়েছেন।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র বলছে, মোহাম্মদপুরের আবাসন প্রকল্পে গত ২৮ ও ২৯ মার্চ বরাদ্দ পাওয়া ২৯ সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে ফ্ল্যাটের মূল্য বাবদ প্রথম কিস্তিতে ৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, আগের ফ্ল্যাটটি তিনি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষকে ফিরিয়ে দিয়ে নতুন ফ্ল্যাট নিয়েছেন। তাঁর দাবি, এটা অনিয়ম নয়।
গৃহায়ণেরই একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, এভাবে অনিয়মকে নিয়ম করলে অনেকে পছন্দমতো ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পরিবর্তন করবেন। এতে বিশৃঙ্খলা বাড়বে।
শওকত আলী ছাড়াও অনিয়ম করে এ প্রকল্পে আরও যে তিনজনকে ফ্ল্যাটের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাঁরা হলেন গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ভূমি) মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক আজিজুর রহমান ও পরিচালক জাজরীন নাহার।
শর্ত অনুযায়ী, ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের (পদায়ন ও প্রেষণে নিয়োজিত) ন্যূনতম ১ বছরের চাকরিকাল পূর্ণ হতে হবে। তবে আশরাফ হোসেন যখন আবেদন করেন, তখন গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষে তাঁর দায়িত্ব পালনের সময় ছিল তিন থেকে সাড়ে তিন মাস। এ ছাড়া আজিজুর রহমান ও জাজরীন নাহারকে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে গৃহায়ণের কোটায়।
শর্ত ভঙ্গ করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান দেলওয়ার হায়দারের বরাতে সংস্থার সচিব মোহাম্মদ উল্ল্যাহ বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই তাঁদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এমনকি বোর্ড সভায় এর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ফ্ল্যাট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত করা উচিত। পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।