সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তৃতীয় পর্যায়ে নির্মাণকাজের অংশ হিসেবে চলছে বিভিন্ন রকম কার্যক্রম। গতকাল বেলা আড়াইটায়
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তৃতীয় পর্যায়ে নির্মাণকাজের অংশ হিসেবে চলছে বিভিন্ন রকম কার্যক্রম। গতকাল বেলা আড়াইটায়

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

নির্মাণকাজ শেষ হলো না ২২ বছরেও

■ কাচের তৈরি দেড় শ ফুট উঁচু স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ২৯ জুন।

■ এটি তৈরি হয়েছে দুটি পর্যায়ে। সময় লেগেছে প্রায় ১৬ বছর।

■ খরচ হয়েছে ২৬২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

■ চলছে তৃতীয় পর্যায়ের কাজ। খরচ হচ্ছে আরও ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

২২ বছর কাটল। কাটাছেঁড়া থেকে রেহাই পেল না রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রের একমুঠো সবুজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। গাছগাছালি কেটে, মাটি খুঁড়ে, টন টন লোহালক্কড়, লাখ লাখ ইট, শত শত কাচের ফলক এনে ১৬ বছর ধরে বানানো হলো স্বাধীনতা স্তম্ভ। আরও অনেক কিছু। এখন ইট-কাঠের শব্দ শোনা যাচ্ছে উদ্যানের উত্তর দিকে। সেখানে ছিল শিশুপার্ক।

ছেলেমেয়েদের নিয়ে এখানে বেড়াতে আসতেন শহরের ইটের খোপের বাসিন্দারা। কিছু সবুজের স্পর্শ, কিছু খোলা হাওয়া গায়ে লাগত। এখন পুরো এলাকা টিন দিয়ে ঘেরা। দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ। অনেক দিন ধরে ঢিমেতালে চলছে কার পার্কিং এবং আরও অনেক স্থাপনা তৈরির কাজ। ইতিমধ্যেই এখানকার সবুজ প্রায় নিঃশেষিত। উদ্যানের বুকজুড়ে এই খনন, নির্মাণকাজ শেষ হতে আরও কত বছর লাগবে, তা অজানা।

সরেজমিনে দেখা গেল, উত্তর পাশের শিশুপার্ক উদ্যানের সঙ্গে একীভূত করে চলছে তৃতীয় পর্যায়ের উন্নয়নকাজ। পুরোনো রাইডগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সংস্কার করে এখানে থিম পার্ক করা হবে। এখন এখানে ভূগর্ভস্থ পার্কিং ও মসজিদের কাজ চলছে।

এ ছাড়া উদ্যানের যে অংশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য এবং যেখানে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল, সেখানেও একটি ভাস্কর্য তৈরি করা হবে। এ ছাড়া হাঁটাপথ, ফোয়ারাসহ অনেক রকম কাজ হবে উদ্যানজুড়ে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজে খরচ হয়েছে ২৬২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সাল থেকে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে। এর জন্য খরচ হবে আরও ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে নানা কারণে কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে, গতিও ধীর।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ কাজের উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। সেই অনুসারে দ্রুতই কাজ করা হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে মহান মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো সংরক্ষিত হবে। আগামী প্রজন্ম এখানে এসে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারবে। তা ছাড়া শিশুদের জন্য বিনোদনের চমৎকার ব্যবস্থাও এখানে থাকবে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না।

তৃতীয় পর্যায়ে যা হচ্ছে

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আগে ছিল রেসকোর্স ময়দান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার দাবিতে দেশ যখন উত্তাল, সেই সময় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এই রেসকোর্স ময়দানেই লাখো জনতার মহাসমাবেশে তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। তর্জনী উঁচিয়ে বর্জনির্ঘোষ কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ময়দানের যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু এই ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেখানেই তৈরি করা হচ্ছে তর্জনী উঁচিয়ে তাঁর ভাষণদানের ভাস্কর্য। ব্রোঞ্জের তৈরি মূল বেদিসহ এই ভাস্কর্য হবে প্রায় ২৬ ফুট উঁচু। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর মূল ভাস্কর্যের উচ্চতা হবে ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চি।

প্রতিটি বড় শহরে ২০ শতাংশ সবুজ স্থান থাকা প্রয়োজন। কিন্তু কাগজে-কলমে নতুন ঢাকায় আছে ১২ আর পুরান ঢাকায় ৫ শতাংশ।
কাজী আজিজুল মওলা, অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

এ ছাড়া আরও একটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য হবে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যেখানে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল ঠিক সে স্থানে। আলোকচিত্র অনুসারে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরের সময় সেখানে পাকিস্তানি জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি, মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাসহ মোট ১১ জন উপস্থিত ছিলেন। ভাস্কর্যটি হবে হুবহু নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার দৃশ্যের মতো। ২ জেনারেলসহ সেই ১১ জন থাকবেন। টেবিলটিও হবে মূল টেবিলের মতো। জাতীয় জাদুঘরে মূল টেবিলটি সংরক্ষিত আছে। ভাস্কর্যটি হবে সাড়ে ১০ ফুট। প্রায় দেড় ফুট ভিত্তিভূমির ওপর তৈরি করা হবে এটি। লম্বায় হবে প্রায় ২০ ফুট আর প্রস্থ হবে ১৬ ফুট।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সুহৃদ ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরকালে এই রেসকোর্স ময়দানেই ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর সংবর্ধনার জন্য তৈরি করা হয়েছিল ইন্দিরা মঞ্চ। এই ইন্দিরা মঞ্চের জায়গাও চিহ্নিত করা হয়েছে, সেখানে একটি স্মৃতিস্মারক তৈরি করা হবে।

এ ছাড়া স্বাধীনতা স্তম্ভের জলাধার সংস্কার করে এখানে তৈরি করা হবে ফোয়ারা। আলোকসম্পাত ও শব্দের সঙ্গে এই ফোয়ারার পানির নৃত্যময় প্রক্ষেপণ দেখা যাবে। বেড়াতে আসা লোকজনের বিশ্রামের জন্য তিন রকমের নকশার বেঞ্চ তৈরি করা হবে উদ্যানের বিভিন্ন স্থানে। সংস্কার করা হবে বাংলা একাডেমির প্রান্তের উন্মুক্ত মঞ্চটিও। চারুকলা অনুষদের অংশে ছবির হাটেও পরিবর্তন আসবে। নতুন আদলে গড়ে তোলা হবে এটি।

তৃতীয় পর্যায়ে তৈরি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, থিম পার্ক, ৫৭০টি গাড়ি রাখার ভূগর্ভস্থ পার্কিংসহ অনেক কিছু। থাকবে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো।

বড় রকমের পরিবর্তন হচ্ছে শিশুপার্কের অংশে। সরেজমিনে দেখা গেল, ইতিমধ্যেই শিশুপার্কের পূর্ব পাশে মসজিদ তৈরির কাজ অনেকটা এগিয়েছে। তা ছাড়া ঢাকা ক্লাবের বিপরীত পাশে পার্কের আগের কার পার্কিংয়ের জায়গায় ১ লাখ ৭১ হাজার বর্গফুট আয়তনের ভূগর্ভস্থ পার্কিংয়ের ঢালাইয়ের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এখানে ৫৭০টি গাড়ি রাখা যাবে। এ ছাড়া উদ্যানের ভেতরের নতুন পায়ে চলার পথ ও সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে।

এসব ছাড়াও এখানে শিশুদের বিনোদনের জন্য একটি থিম পার্ক নির্মাণ করা হবে। এর সামনে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি নিয়ে ম্যুরাল। থাকবে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। তৈরি করা হবে ফুল ও খাবারের দোকান।

উদ্যানের তৃতীয় পর্যায়ের এই উন্নয়নকাজের স্থাপত্য নকশা করেছে স্থাপত্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি আ স ম আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাঁর ভাস্কর্য স্থাপন করা হচ্ছে এটা খুবই আনন্দের বিষয়। তা ছাড়া এখানে থিম পার্ক, পার্কিংসহ অন্যান্য কাজ শেষ হলে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নগরবাসীর বেড়ানোর জন্য আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হবে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করায় নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে।

যা হলো ২২ বছরে

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ২৯ জুন। উদ্যানে দেড় শ ফুট উচ্চতার কাচের তৈরি স্বাধীনতা স্তম্ভ ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি হয়েছে দুটো পর্যায়ে।

প্রথম পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প’র প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দ ছিল ৮১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এতে উদ্যানের উত্তর প্রান্তে তৈরি করা হয়েছে শিখা চিরন্তন। এর সামনে থেকে একটি ‘অ্যাপ্রোচ প্লাজা’ করা হয়, এটি গেছে স্বাধীনতা স্তম্ভ পর্যন্ত। স্তম্ভের পাশের জলাধার, ভূগর্ভস্থ জাদুঘর, জলাধারের দেয়ালে ম্যুরাল স্থাপন এবং বাংলা একাডেমির সামনের অংশে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ করা হয় প্রথম পর্যায়ে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মিত হয়েছে বহুল আলোচিত স্বাধীনতা স্তম্ভ। কাচের তৈরি এই স্তম্ভের স্থাপত্য নকশা করেছিলেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স আরবানার স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাসসুম। ‘এনডিই-নোভাম কনসোর্টিয়াম’ নামের বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান স্তম্ভটি নির্মাণ করে। কাচের এই অভিনব স্তম্ভটির নির্মাণ ২০০৯ সালে শুরু হয়। কাজ শেষ করতে সময় লেগে যায় ২০১৪ সাল পর্যন্ত। খরচ হয় ১৮১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। স্তম্ভ ছাড়াও দ্বিতীয় পর্যায়ে জলাধার সংস্কার, উদ্যানের চারপাশে স্টিলের বেড়া ও ছয়টি নতুন ফটক তৈরি করা হয়।

১৯৯৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত এই দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে নির্মাণকাজ চলতে থাকায় রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রের এই সবুজ উদ্যানটির পরিবেশ শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। লোকজনের সেখানে যাওয়ার মতো পরিবেশ ছিল না। স্তম্ভ নির্মাণের পর উদ্যানটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। গত ২০১৪ সাল থেকে দক্ষিণ প্রান্তে একুশের বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে গাছপালা কেটে স্থাপনা নির্মাণ নিয়ে পরিবেশবাদী ও নগর পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে।

ঢাকায় এমনিতে সবুজ উদ্যান বিশেষ নেই। তা ছাড়া খেলাধুলা করা বা নাগরিকদের জন্য খোলামেলা পরিসর রাখার জন্য এই উদ্যানটি উন্মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন পরিবেশবাদীরা। তাঁরা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিত করেই ঢাকার এই খোলা ময়দানকে উন্মুক্ত রাখা যেত।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী আজিজুল মওলা প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি বড় শহরে ২০ শতাংশ সবুজ স্থান থাকা প্রয়োজন। কিন্তু কাগজে-কলমে নতুন ঢাকায় আছে ১২ আর পুরান ঢাকায় ৫ শতাংশ। বাস্তবে সবুজ স্থান আরও কম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় স্থাপনা নির্মাণ করার আগে রমনাকে যুক্ত করে এই সবুজ দ্বীপটি সংরক্ষণ করা যেত। তবে এখনো যে অবস্থায় রয়েছে তা যেন আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

এই নগর-পরিকল্পনাবিদ মনে করেন, এসব নির্মাণকাজের সঙ্গে পরিবেশবিদ ও নগর-পরিকল্পনাবিদদের যুক্ত করা প্রয়োজন। তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করে পরিবেশের যতটা সম্ভব কম ক্ষতি হয়, এমন করে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে হবে।