ছোট্ট তুলতুলে মায়াভরা মুখটি উপেক্ষা করে কী কারণে এক-দেড় মাসের শিশুটিকে বাক্সবন্দী করে রেখে যাওয়া হয়েছিল, তা জানা যায়নি। তবে একজন হারুনকে জানা গেছে, যিনি শিশুটিকে পরম মমতায় বুকে আগলে রাতভর থানা আর হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছিলেন। হারুনের ভাষায়, ‘কী মায়া, বোঝানো যাইব না!’
পৃথিবী চেনার আগেই আপনজনের নিষ্ঠুরতার শিকার ছেলেশিশুটিকে গত রোববার রাতে শাহবাগে একটি বাস কাউন্টারের বাক্স আকৃতির টেবিলের ঢাকনার নিচে আটকে থাকা অবস্থায় পান মো. হারুন (২৬)। শিশুটিকে নিয়ে ভোর পর্যন্ত তিনি থানা-হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছেন। টিনের দুধ, ফিডার কিনে দুধ বানিয়ে খাইয়েছেন। পেশায় বাবুর্চি হারুনের ভাষায়, ‘বাচ্চার ওপর মায়া পইড়া গেছে।’ তাই শিশুটির অভিভাবকত্ব পেতে এখন আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে চাইছেন।
রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) তাহমিনা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হারুন নামের এক ব্যক্তি শিশুটিকে নিয়ে থানায় আসেন। শিশুটির অভিভাবকত্ব দেওয়ার বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন। গত সোমবার শিশুটিকে আজিমপুরে ছোটমণি নিবাসের তদারকিতে দেওয়া হয়েছে।
হারুন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের কাছে ফুটওভারব্রিজের নিচের ফুটপাতের হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেন। কাজের সূত্রে প্রায় এক যুগ ধরে তিনি ঢাকায়। বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে। গ্রামের বাড়িতে থাকেন মা, স্ত্রী এবং তাঁর ৮ ও ৩ বছর বয়সী দুই মেয়ে।
ঘটনার দিনের বর্ণনা করতে গিয়ে হারুন মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, গত রোববার রাত ৯টার পর তিনি চায়ের কাপ হাতে ঢাকা ক্লাবের সামনে বাসের টিকিট কাউন্টারে গিয়ে বসেন। ওই সময় কাউন্টারগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কাউন্টারগুলোর বাক্স আকৃতির টেবিলের ভেতর থেকে তিনি শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পান। এই টেবিলগুলোর উপরিভাগ খোলা যায়। ঢাকনা খুলে তিনি দেখতে পান ময়লা গেঞ্জি-প্যান্ট পরানো এক শিশু কাঁদছে।
হারুন বলেন, কেউ হয়তো কাউন্টার বন্ধ হওয়ার পর সুযোগ বুঝে শিশুটিকে ফেলে চলে গেছে। তিনি শিশুটিকে কোলে তুলে প্রথমে রমনা থানায় যান। রাত একটার দিকে পুলিশ শিশুটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তাঁকে সঙ্গে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান, শিশুটি সুস্থ আছে।
হারুন রাতেই স্ত্রী সায়মা বেগমকে ফোনে ঘটনাটি জানিয়ে শিশুটিকে নিজেদের কাছে নিতে চান। তাঁর স্ত্রীও রাজি হন। পরদিন সোমবার বিকেলে শিশুটিকে নেওয়ার জন্য স্ত্রী চাঁদপুর থেকে ঢাকায় আসেন। তখনো তাঁরা জানতেন না যে কেউ চাইলেই কোনো শিশুকে দত্তক নিতে পারেন না, এর জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাই এখনই শিশুটিকে পাবেন না জেনে সায়মা বেগম গ্রামে ফিরে গেছেন।
শিশুটিকে নিতে চাইছেন কেন জানতে চাইলে হারুন বলেন, ‘যেভাবে পাইছি, পাইছি। এখন আমার মায়া পইড়া গেছে। মায়া কাউরে বোঝানো যায় না। আমার স্ত্রী বাচ্চাটারে কোল থেইকা নামাতেই চাইতেছিল না। সে (স্ত্রী) অনেক মন খারাপ করে বাড়ি গেছে।’
হারুন জানান, তাঁর মাসে আয় ১৭-১৮ হাজার টাকা। তাঁর সামর্থ্যের মধ্যে তিনি শিশুটিকে বড় করতে পারবেন। বললেন, ‘আপনারা দেশবাসী সবাই মিলে বাচ্চাটা আমার হাতে তুলে দিলে খুশি হব। শেষ রক্তবিন্দু দিয়া মানুষ করব।’ তিনি জানালেন, শিশুটিকে নেওয়ার জন্য আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে এক আইনজীবীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।
আজিমপুর ছোটমণি নিবাসের একজন কর্মী প্রথম আলোকে জানান, নতুন শিশুটিকে নিয়ে নিবাসে এখন ৭ বছর বয়সী ২৮টি শিশু রয়েছে। তাঁরা যে কাউকে অভিভাবকত্ব দিতে পারেন না। যিনি দত্তক নিতে আগ্রহী, তাঁকে আদালতের মাধ্যমে আবেদন করে প্রয়োজনীয় অনুমতি নিতে হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মনীষা ব্যানার্জি প্রথম আলোকে বলেন, প্রায়ই এভাবে নবজাতক ও শিশু ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। পথচারী বা স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে পুলিশ জানতে পারে। এই শিশুদের পুলিশ মামলা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর বিভাগে এখন এমন দুটি নবজাতকের চিকিৎসা চলছে। নবজাতক দুটি সুস্থ হওয়ার পর সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা হবে।