মো. আবু বকর সিদ্দিকীর জমি বন্ধক দিয়ে ঋণ। ব্যাংক নিলামে বিক্রি করেছে আরেক আবু বকরের চারতলা বাড়ি।
অগ্রণী ব্যাংকের নবাবপুর শাখা থেকে ঋণ নিতে মেসার্স ট্রেড ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড যে ছয়টি জমি বন্ধক রেখেছিল, তার একটি মো. আবু বকর সিদ্দিকী ওরফে সিদ্দিকুর রহমানের। ১৬ বছরের আইনি লড়াইয়ে জিতে অগ্রণী ব্যাংক আবু বকর সিদ্দিকীর বদলে আবু বকর সিদ্দিকের চারতলা বাড়ি নিলামে তুলে বেচে দিয়েছে। ব্যাংক বলছে, তাদের কোনো দোষ নেই। সব দোষ নিলামে ওঠা বাড়ির মালিক আর নিলাম ক্রেতার। অন্যদিকে মালিক আর ক্রেতা দুষছেন ব্যাংককে।
রাজধানীর ৩২২/১ খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দিক আদালতে অভিযোগ দায়ের করে লিখেছেন, আদালতকে অন্ধকারে রেখে ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা, নিলাম ক্রেতা ও আদালতের নিয়োগ করা বেইলিফ (জারিকারক) বদমতলবে এই কাজ করেছেন। নিলামে বাড়ি ও জমিটি কিনেছেন ওয়ারীর বাসিন্দা রিয়াজ রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি টাকা দিয়েছেন। জমি বুঝিয়ে দেওয়া ব্যাংকের কাজ। তিনি এর দায় নেবেন কেন?
ঘটনাস্থলে গিয়ে এবং ব্যাংক, ভূমি নিবন্ধন অফিস ও সিটি করপোরেশনের কাগজপত্র যাচাই করে দেখা যাচ্ছে, আবু বকর সিদ্দিক ব্যাংকের ভুলের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যেই গত ৯ ডিসেম্বর আদালতের প্রতিনিধি, নিলাম ক্রেতা, পুলিশ এবং মাথায় লাল ফিতা বাঁধা শতাধিক শ্রমিক আবু বকর সিদ্দিকের বাসার দখল নেন। ভাড়াটেদের জোর করে বের করে দেন ও ভাঙচুর চালান। আশপাশের লোকজনের বাধায় পরে তাঁরা চলে যান।
আবু বকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ৩৫ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। সম্পদ বলতে চারতলা এই বাড়ি। দেশে ফিরে এই বাড়ির ভাড়া দিয়েই সংসার চালান। চারতলা বাড়ির ছয়টি ফ্ল্যাটে ভাড়াটে ছিল। বিনা নোটিশে তাঁদের বের করে দেওয়া হয়। ওই সময় তিনি বরিশালে ছিলেন।
গোলমালটা কোথায় খুঁজতে প্রথম আলো ঘটনার শিকার ব্যক্তি, ব্যাংক, ভূমি অফিস, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগ ও ট্রেড ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন রুগ্ণ। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রহিম নিজেই প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন, এই আবু বকর সিদ্দিকের কোনো জমি তাঁদের প্রতিষ্ঠানে বন্ধক ছিল না। ছিল আবু বকর সিদ্দিকী ওরফে সিদ্দিকুর রহমানের। ২৪ থেকে ২৫ বছর ধরে তিনি ওই ব্যক্তিকে খুঁজে পাচ্ছেন না।
ব্যাংক অবশ্য দায় স্বীকার করতে চাইছে না। অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস–উল–ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নবাবপুর শাখার উপমহাব্যবস্থাপক শেখ মনিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। শেখ মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯২ সালে মেসার্স ট্রেড ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে ঋণ দেওয়ার সময় তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক মো. রুহুল আমিন ও সুবীর কুমার চক্রবর্তী যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তাঁরা অবসরপ্রাপ্ত এবং তাঁদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। নথিপত্র দেখে মনে হয়েছে, তাঁরা জমি দেখেই ঋণ দিয়েছেন।
জমি বন্ধকদাতা আবু বকর সিদ্দিকীকে খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। ব্যাংকে বন্ধক থাকা জমি ৬.৬ শতাংশ। নিলামে বিক্রি হওয়া জমি ৩.৩ শতাংশ।
শেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, ঋণ নেননি এমন একজনের জমি নিলামে তুলে বেচে দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। ব্যাংকের তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ার কোম্পানি ‘গ্লোবাল সার্ভেয়ার’–এর মাধ্যমে জমি শনাক্ত করে মামলা দায়ের করে ব্যাংক। সে অনুযায়ী নোটিশ জারি ও ঢোল–শোহরত করা হয় এবং দুটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সব আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আদালতের তত্ত্বাবধানে নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। পরে আদালত নিলাম ক্রেতাকে জমির দখলস্বত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য নেজারত শাখাকে আদেশ দেন।
তবে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটিকে জমির বিপরীতে ঋণ দেওয়ার আট বছর পর ২০০০ সালে ঋণ পুনঃ তফসিল করার সময় ব্যাংক মালিকপক্ষকে জমিটির অবস্থান নিশ্চিত করতে বলেছিল। ২০০৯ সালে আবারও জমিটির অবস্থান নিশ্চিত করতে গ্লোবাল সার্ভেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি জরিপ করেছে। এরপর তা যাচাই করতে আসেন ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার মাহাবুবুল হক ও ব্যবস্থাপক (ঋণ) সৈয়দ মো. রাকিবুল করিম। প্রশ্ন উঠেছে, বন্ধক থাকা ৬ দশমিক ৬ শতাংশ জমির বদলে ব্যাংক কেন ৩ দশমিক ৩ শতাংশ জমি নিলামে বেচল?
যেখানে অসংগতি
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৯২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অগ্রণী ব্যাংক নবাবপুর শাখা রপ্তানিমুখী সোয়েটার কারখানা ট্রেড ফ্যাশনকে ৪৭ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি কাপড় ও সুতা আমদানির জন্য ব্যাংকে ব্যাক–টু–ব্যাক ঋণপত্র বা এলসি খোলে। রপ্তানি করতে না পারায় তারা আমদানি ঋণপত্রের মূল্য শোধ করতে ব্যর্থ হয়। তখন এই অগ্রণী ব্যাংকই বিদেশে তাদের দেনা মেটায়। এরপরও দফায় দফায় প্রতিষ্ঠানটি ঋণ নেয় এবং প্রতিবারই ব্যাংকের শর্ত ভঙ্গ করে। টাকা উদ্ধারে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২০০০ সালের পর চার দফায় প্রতিষ্ঠানটির মালিকদের আইনি নোটিশ দেয়। সব মিলিয়ে ব্যাংকের মোট পাওনা ৯০ লাখ ৯০ হাজার ৫৬৭ টাকা। ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি মোট ছয়টি জমি বন্ধক রেখেছিল। টাকা উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত ২০০৪ সালের ৩১ মার্চ ও ৪, ৬ ও ৮ এপ্রিল চারটি দৈনিকে পাঁচটি বন্ধকি জমি বিক্রির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ব্যাংক। আগ্রহী ক্রেতা না পাওয়ায় সবশেষে অগ্রণী ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে যায়। গত ১৬ বছরে আবু বকর সিদ্দিকী ওরফে সিদ্দিকুর রহমান ছাড়া পাঁচটি জমির মালিকই নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
অগ্রণী ব্যাংকে গচ্ছিত দলিলের অনুলিপি অনুযায়ী, আবু বকর সিদ্দিকী ওরফে সিদ্দিকুর রহমানের দলিল নম্বর ২২৯৭০। ১৯ অক্টোবর ১৯৮৫ সালে জমিটি তিনি কিনেছিলেন মনোরঞ্জন দাসের কাছ থেকে। জমির পরিমাণ ৬ শতাংশ। তাঁর বাবার নাম আবদুর রহমান হাওলাদার, স্থায়ী ঠিকানা ৬০৬, খিলগাঁও। জমিটির এস এ দাগ নম্বর ২০১। সর্বশেষ ঢাকা সিটি জরিপে এ জমিটির পরিমাণ, অবস্থান কোনো কিছুই শনাক্ত করা হয়নি বলে কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে, ৩২২/১ খিলগাঁওয়ের হাওয়াই গলির জমি ও এর ওপর চারতলা ভবনের মালিক আবু বকর সিদ্দিক। তিনি প্রথম আলোকে তাঁর জমির যে দলিল দেখিয়েছেন, সেটির নম্বর ৬১৪৫। জমিটি তিনি ১৯৮২ সালের ১১ অক্টোবর আনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে কিনেছিলেন। জমির পরিমাণ ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট অনুযায়ী আবু বকর সিদ্দিকের বাবার নাম আবুল হোসেন মৃধা। দুটি জমির চৌহদ্দির বিবরণও আলাদা। তবে দুটি জমিরই দাগ এস এ জরিপে ২০১।
তেজগাঁওয়ের ভূমি নিবন্ধন অফিসে (রেজিস্ট্রি) দুটি দলিলই যাচাই–বাছাই করা হয়। কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেন, দুই জমির অবস্থান ও মালিক আলাদা।
আবু বকর সিদ্দিকী ওরফে সিদ্দিকুর রহমান কে?
অগ্রণী ব্যাংকে আবু বকর সিদ্দিকী ওরফে সিদ্দিকুর রহমানের কোনো ছবি নেই। তাঁর সঙ্গে ট্রেড ফ্যাশনের মালিকানা বা অংশীদারত্বের সম্পর্কও ছিল না। ব্যাংক বলছে, সরাসরি কোনো সম্পর্ক না থাকায় তাঁরা আবু বকর সিদ্দিকী ওরফে সিদ্দিকুর রহমানের কোনো ছবি রাখেননি। তাঁরা শুধু জানেন, সিদ্দিকীর ঠিকানা ৬০৬ খিলগাঁও। তাঁর কোনো স্থায়ী ঠিকানার উল্লেখ নেই কাগজপত্রে। তাঁকে ব্যাংকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক মো. আকরাম হোসেন খান।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৬০৬ নামে কোনো হোল্ডিং নম্বর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নেই। তবে ৬০৬/১ আছে। এই হোল্ডিং নম্বরে আছেন কাজী আমিনুল ইসলাম নামের এক চিকিৎসক। তাঁর সঙ্গে আবু বকর সিদ্দিকী ওরফে সিদ্দিকুর রহমানের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ট্রেড ফ্যাশনের সাবেক পরিচালক মো. আকরাম হোসেন খানের ছেলে মিনহাজ হোসেনকে খুঁজে পেয়েছে প্রথম আলো। মিনহাজ প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৪ সালে তাঁর বাবা মারা যান। তিনি তখন মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিলেন। বড় ছেলে হওয়ায় লেখাপড়া ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। প্রথম প্রথম ট্রেড ফ্যাশনে যেতেন। ওই সময় আবু বকর সিদ্দিকী নামের এক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে আসতেন, টাকাপয়সা নিয়ে যেতেন। তবে ২০ বছরে তিনি আর ওই ব্যক্তিকে দেখেননি।
আর ট্রেড ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রহিম বলেন, তাঁর যত দূর মনে পড়ছে, আবু বকর সিদ্দিকী ওরফে সিদ্দিকুর রহমান কোনো চাকরি বা ব্যবসা করতেন না। তিনি নিজেকে অনেক ভূসম্পত্তির মালিক বলে দাবি করতেন। প্রতিষ্ঠানটির একসময়কার পরিচালক আকরাম হোসেন খান তাঁর জমির দলিল দেখিয়েই পরিচালকের পদ পেয়েছিলেন।
এদিকে, ব্যাংক কর্মকর্তারা এখন অন্য কথা বলছেন। তাঁরা বলেন, মার্চে করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে তাঁরা আবু বকর সিদ্দিকের বাসায় গিয়েছিলেন। তাঁর বাবার নাম জানতে চাইলে তিনি উল্টো জিজ্ঞেস করেন, কেন শুধু শুধু অচেনা লোককে তিনি বাবার নাম বলবেন।
জমি বন্ধক নেওয়ার আগে তাঁর অস্তিত্ব আছে কি না খোঁজ নেননি? এ প্রশ্নের জবাবে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক শেখ মনির প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্ধক নিলে তো দেখার কথা। নিশ্চয়ই দেখা হয়েছিল।’ তাহলে সেই জমি ভোজবাজির মতো কোথায় মিলিয়ে গেল, তার জবাব শেখ মনির দিতে পারেননি।
এ বিষয়ে কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী ইমাম হোসেন তারেক প্রথম আলোকে বলেন, এটা পরিষ্কার জালিয়াতি। জমি বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার আগে ব্যাংকের বেশ কিছু বিষয় যাচাই–বাছাইয়ের বাধ্যবাধকতা আছে। এ ঘটনায় ব্যাংক কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না।