দীর্ঘ দুই বছর প্রিন্ট–সংক্রান্ত জটিলতায় চালকের লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ ছিল। মঙ্গলবার থেকে নতুন করে এ কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে প্রথম দিনে মুঠোফানে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র একজন লাইসেন্স নিতে এসেছিলেন বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, গত সোমবার ঢাকা অঞ্চলের তিনটি কার্যালয়ের জন্য ১ হাজার ১২০টি লাইসেন্স হাতে পায় তারা। তবে বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে সারা দিনে লাইসেন্স নিতে আসেন মাত্র একজন, রাশেদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। ঢাকার অন্য দুটি কার্যালয়—উত্তরা ও কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া থেকে এদিন কতটি লাইসেন্স বিলি করা হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি।
রাশেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক হয়রানির পর লাইসেন্স পাইছি। আনন্দ লাগছে। তিন বছরে পুলিশ ২০ হাজার টাকার মামলা দিছে। এখন হাতে একটা বল আছে। মাঝে চাকরি খুঁজতে গেছিলাম, কিন্তু লাইসেন্সের কারণে পাইনি।’ বাকিরাও দ্রুত লাইসেন্স পেলে ভালো হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। রাশেদুল জানান, ২০১৮ সালে তিনি পুরোনো লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করেন। এরপর লাইসেন্স হাতে পাওয়ার সম্ভাব্য তারিখ তিনবার পেছায় বিআরটিএ। কারণ লাইসেন্স প্রিন্ট করা যাচ্ছিল না।
দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর মাত্র একজন লাইসেন্স নিতে আসার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আসলে যাঁরা গাড়ি চালান তাঁরা মুভমেন্টের (চলাচল) মধ্যে থাকেন। তাই অনেকে খুদে বার্তা পেয়েও আসতে পারেননি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০১৬ সালে টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয় বিআরটিএর। সে অনুযায়ী তাদের চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৫ লাখ লাইসেন্স সরবরাহ করার কথা ছিল। তবে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি বেশির ভাগ লাইসেন্স দিয়ে দেয় তারা। ফলে তখন থেকে গণহারে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন জটিলতায় টাইগার আইটির সঙ্গে আর চুক্তি নবায়ন করেনি বিআরটিএ। পরে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয় তাদের। সে অনুযায়ী গত জুলাই থেকে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ শুরু করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে তারা জুলাই থেকে পাওয়া আবেদনগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
তবে জুলাইয়ের আগে পর্যন্ত নবায়ন ও নতুন লাইসেন্সের আবেদন নেওয়া বন্ধ করেনি বিআরটিএ। কিন্তু সেই আবেদনকারীদের লাইসেন্স দেওয়া যায়নি। এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৪৫ হাজারে। জটে পড়া এসব লাইসেন্স প্রিন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেনাবাহিনীকে। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে এগুলো ছাপা হচ্ছে।
বিআরটিএ সূত্র বলছে, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে প্রতিদিন প্রায় আট হাজার লাইসেন্স প্রিন্ট হচ্ছে। তবে সামনে এর সংখ্যা বাড়ানো হবে। প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক ১৪ হাজার প্রিন্ট করার সক্ষমতা রয়েছে।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁদের আগে দেব। আমাদের ডেটাবেজে তেমন ব্যবস্থা আছে। অস্থায়ী ভিত্তিতে যাঁরা গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তাঁদেরগুলো আগে দেব।’ আগামী ছয় মাসের মধ্যে জট শেষ হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
দীর্ঘ জটের পর লাইসেন্স দেওয়ার প্রথম দিন বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে মাত্র একজন লাইসেন্স নিলেও অনেকে আসেন খুদে বার্তা না পেয়েই। তাঁদের অনেকেরই ধারণা ছিল, এদিন সবাইকে লাইসেন্স দেওয়া হবে। তারা সবাই লাইসেন্স দেওয়ার সম্ভাব্য তারিখ জানিয়ে মুঠোফোনে যে খুদে বার্তা দেওয়া হয়, সেই তারিখ পিছিয়ে পুনরায় নতুন তারিখ দেওয়ার অনুরোধ জানান।
প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা মিন্টুর সঙ্গে। তিনি জানান, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁর লাইসেন্সের মেয়াদ ছিল। নবায়নের আবেদন করেন ওই বছরের সেপ্টেম্বরে। তখন ‘প্রাপ্তি স্বীকার রসিদ’ দেয় বিআরটিএ। এতে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে খুদে বার্তা পাঠানোর সম্ভাব্য তারিখ লেখা আছে ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১। কিন্তু আজ পুলিশ লাইসেন্সের মেয়াদ নেই বলে মামলা দেয়। এ কারণে তিনি এসেছেন লাইসেন্স নিতে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁকে খুদে বার্তা পাওয়ার সম্ভাব্য তারিখ বাড়িয়ে ১২ জুলাই, ২০২২ করে দিয়েছে।
‘প্রাপ্তি স্বীকার রসিদ’কে ‘মোটর ভেহিকেলস রুলস ১৯৮৪–এর ১৭(১) বিধি অনুযায়ী গাড়ি চালানোর অস্থায়ী অনুমতিপত্র’ বলছে বিআরটিএ। মিন্টু বলেন, ‘আমার প্রাপ্তি স্বীকার রসিদই অস্থায়ী লাইসেন্স, তবু আমাকে মামলা দেওয়া হয়েছে।’
কালাম নামের আরেকজন চালক জানান, তাঁর নবায়নের আবেদনের পর লাইসেন্স পাওয়ার তারিখ তিনবার পেছানো হয়েছে। তাঁর লাইসেন্স পাওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ১০ আগস্ট। তখন লাইসেন্স নিতে এলে নতুন তারিখ দেওয়া হয় ১৩ জুলাই, ২০২১; পরে আবার বাড়িয়ে (৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) দেওয়া হয়েছে।
কালাম আরও বলেন, কার্ড না পেলে মালিক মানেন না। গাড়ি চালাতে গেলে ভয় লাগে, কখন আবার সার্জেন্ট মামলা দিয়ে দেন! লাইসেন্স থাকলে বল খাটানো যায়। পুলিশ এসব কাগজ মানতে চায় না।