পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন বিনোদনকেন্দ্র

এই নকশা অনুযায়ী ঢেলে সাজানো হচ্ছে নাজিমুদ্দিন রোডে পুরোনো কেন্দ্রীয় করাগার।
এই নকশা অনুযায়ী ঢেলে সাজানো হচ্ছে নাজিমুদ্দিন রোডে পুরোনো কেন্দ্রীয় করাগার।

পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার কারাস্মৃতিজড়িত স্থাপনা জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া নাগরিকদের জন্য থাকছে পার্ক, মাঠ, কমিউনিটি সেন্টারসহ নানান নাগরিক সুবিধা। এই সংরক্ষণ ও রূপান্তরের কাজ এগিয়ে চলেছে। আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ এটি উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

‘পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ইতিহাস, ঐতিহাসিক ভবন সংরক্ষণ ও পারিপার্শ্বিক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে এই সংরক্ষণ ও রূপান্তরের কাজ চলছে। গত বছর নভেম্বরে কারা অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলতি বছরের ২৮ জুন এই প্রকল্প বাস্তবায়নকাজের উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০৭ কোটি ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

নাজিমুদ্দিন রোডের এই কারাগার দেশের প্রাচীনতম কারাগার। প্রায় ২২৮ বছরের পুরোনো এই কারাগারের সঙ্গে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ও ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, মোগল সুবাদার ইব্রাহিম খান ঢাকার চকবাজারে (নাজিমুদ্দিন রোড) একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ১৭৮৮ সালে ওই দুর্গের ভেতরে অপরাধী রাখার জন্য একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণ করা হয়। এই দুর্গকেই একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে রূপান্তর করা হয়।

প্রাচীন কারা ভবনটি ছিল জরাজীর্ণ ও বসবাসের অযোগ্য। তাই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পূর্ব পাশে নতুন আরেকটি কারাগার নির্মাণ করে সরকার। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে নাজিমুদ্দিন রোড থেকে এই কারাগারে বন্দীদের স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকে এই কারাগার অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। এখন কারাগারটি সংরক্ষণ ও সবুজ উদ্যান করার কাজ চলায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা।

কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, পুরান ঢাকার এই কারাগার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতার বহু স্মৃতি বহন করছে। নগর ও প্রত্নতত্ত্বের দিক দিয়েও কারাগারটি তাৎপর্যমণ্ডিত ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই বহুমুখী চিন্তাভাবনা সমন্বয় করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন পুরোদমে কারাগারের সংস্কারকাজ চলছে। সেটা শেষ হলে কারাগারটিকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তখন দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে আগামী প্রজন্ম। এতে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জন্মাবে। নিজের মতো দেশকে ভালোবাসবে তারা।

পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগার সংরক্ষণ ও সংস্কারকাজ চলছে পুরোদমে। গত রোববারের ছবি।

কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পুরোনো কারাগারের জায়গা রয়েছে প্রায় ৩৮ একর। এর মধ্যে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে উঠবে প্রায় ২৫ একর জায়গার ওপর। এ জন্য ২০১৭ সালের অক্টোবরে পুরোনো কারাগারের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ভবন সংরক্ষণ, ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন, পারিপার্শ্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি উন্মুক্ত নকশা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ ও কারা অধিদপ্তর। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় ৩৪টি প্রতিষ্ঠান নকশা ও মডেল জমা দেয়। এর মধ্যে স্থাপনাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘ফর্ম থ্রি আর্কিটেক্টসের’ নকশা সেরা হিসেবে নির্বাচিত হয়।

ফর্ম থ্রি আর্কিটেক্টস সূত্র জানায়, তারা কারাগারের জায়গাটিকে তিনটি জোনে ভাগ করেছে (এ, বি, সি)। এর মধ্যে কারাগারের উত্তর অংশে জোন–এ এলাকায় একটি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। এখানে কনভেনশন হল, সুইমিংপুল, সিনেপ্লেক্স ও চার শতাধিক গাড়ির পার্কিং সুবিধা থাকবে। কারাগারের দক্ষিণ অংশটি জোন-বি। এখানে চক কমপ্লেক্স নামের একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করা হবে। এতে বইয়ের দোকান ও ফুডকোর্ট থাকবে। পাশে শিশুদের খেলার জায়গা, মসজিদ, পুকুর ও ৮৫টি গাড়ির পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও রাখা হবে। এ ছাড়া কারাগারের মাঝের অংশে (জোন-সি) বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও জাতীয় চার নেতা স্মৃতি জাদুঘর, পুরোনো কারাগার ও এর ইতিহাস সংরক্ষণ করা হবে। পাশেই থাকবে কারা উদ্যান, লেক, গ্রন্থাগার, হাঁটাচলার পথ। নির্মাণ করা হবে পৃথক দুটি মসজিদ। সব মিলিয়ে মোট আয়তনের প্রায় অর্ধেক জায়গা উন্মুক্ত রাখা হবে।

ফর্ম থ্রি আর্কিটেক্টসের ম্যানেজিং পার্টনার স্থপতি মোহাম্মদ দিদারুল ইসলাম ভূঞা বলেন, ‘এই নকশা তৈরির আগে স্থানীয় মানুষের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। নকশায় তাঁদের আনন্দ–বিনোদনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পুরান ঢাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন। এ ছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটক বেড়াতে আসবেন।’

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, কারাগারের সীমানার ভেতর ছোট-বড় অনেকগুলো টিনশেড স্থাপনা (স্টাফ কোয়ার্টার) ভাঙার কাজ করছেন শ্রমিকেরা। তবে পদ্মা, মেঘনা, সুরমা নামের তিনটি ভবন, কারা হাসপাতাল, পুরোনো প্রধান ফটক, ফাঁসির মঞ্চসহ ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সেলে কারাবন্দী ছিলেন এবং জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে যে কক্ষে হত্যা করা হয়েছিল, সেটি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণের জন্য কাজ চলছে।

কারা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৭ সালে অক্টোবরে নকশা চূড়ান্ত হওয়ার কয়েক মাস পরই এই কারাগারে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বন্দী হিসেবে রাখা হয়। তখন এই প্রকল্পের কাজ কিছুটা থমকে যায়। পরে গত জুনে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি হাসপাতালেই আছেন। এরপর কারাগারে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নতুন প্রজন্মের কাছে কারাগারটি ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে থাকবে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার মানুষ পাবে সবুজে ঘেরা একটি নান্দনিক স্থাপনা।

প্রকল্প পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, কারাগারের ভেতর ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ৩৬টি স্থাপনা রয়েছে। এগুলো সংরক্ষণ করা হবে। আর কম গুরুত্বপূর্ণ ৯৫টি স্থাপনা ভাঙা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এসব স্থাপনা ভাঙার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখানে পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। এতে একটি বড় অংশ নিয়ে থাকবে সবুজ উদ্যান।

পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের বাসিন্দা ও আদি ঢাকাবাসী ফোরামের সদস্যসচিব জাভেদ জাহান বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায় উন্মুক্ত জায়গা বা সবুজ উদ্যান নেই। আনন্দ-বিনোদনেরও তেমন ব্যবস্থাপনা নেই। তাই কারাগারের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আশায় বুক বেঁধে আছেন স্থানীয় মানুষ।