শাম্মী নাসরিনের এক ছেলে বিয়ে করেছেন গত বছর। আরেক ছেলের বিয়ে আগামী নভেম্বরে। এক মেয়ে পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে। ওজন ৬৩ কেজির আশপাশেই থাকে শাম্মীর। ‘পাওয়ারলিফটিং’খেলায় তৃতীয় স্থান অর্জন করা শাম্মী নিজের সন্তানের বয়সী মেয়ে প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। জিতে যাওয়ার পর অন্য প্রতিযোগীরা ফেসবুকে ‘আন্টি’ লিখেই শুভকামনা জানিয়েছেন। আর নিজের ছেলেরা মাকে নিয়ে গর্ব করে পোস্ট দিয়েছেন ফেসবুকে।
বয়স অনুযায়ী মাস্টার ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতা করতে চেয়েছিলেন শাম্মী। কিন্তু এবার তাঁর বয়সী কোনো নারী প্রতিযোগী ছিলেন না।
বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং অ্যাসোসিয়েশন থেকে শাম্মী এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। অ্যাসোসিয়েশনের ফেসবুক পেজে ‘বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২০’ শাম্মীকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে অন্যদের প্রতিযোগিতায় নাম নিবন্ধনের জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
পাওয়ারলিফটিং মূলত একটি শক্তির খেলা, যা তিনটি লিফটে সর্বোচ্চ ওজনের তিনটি প্রচেষ্টা নিয়ে গঠিত। যেমন স্কোয়াট, বেঞ্চ প্রেস এবং ডেড লিফট। সহজ করে বললে খেলাটি ভারোত্তোলন খেলার মতো। তবে এতে স্কোয়াট মানে ঘাড়ে, বেঞ্চ প্রেস মানে শুয়ে বুকের ওপর এবং ডেডলিফট মানে মাটি থেকে ওজন তুলতে হয়। এই তিনটির স্কোরের ভিত্তিতে প্রতিযোগীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। শাম্মী এই তিনটিতে প্রায় ২৭০ কেজি ওজন তুলেছেন।
হাসতে হাসতে শাম্মী বললেন, ‘করোনায় ঘরে বসে থাকার সময় আমরা কয়েকজন খাট তুলে ঘাড়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জও নিয়েছিলাম।’ কাগজে-কলমে শাম্মীর বয়স ৪৬ বছর, তবে জানালেন, তাঁর প্রকৃত বয়স ৪৮ বছর।
তিন সন্তানের মা শাম্মীকে দেখে চট করে কেউ বুঝতে পারবেন না তিনি এমন একটি কঠিন খেলার সঙ্গে জড়িত। শাড়ি পরেন, তবে জিমে বা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সময় খেলার পোশাক পরেন। ওজনও নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকে তাঁর। জানালেন, মূলত নিজের শরীর ঠিক এবং ফিট রাখার জন্যই পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে ছেলের সঙ্গে জিমে গিয়ে ব্যায়াম করা শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে ছেলে জিমে যাওয়া বাদ দিলেও তিনি তা ধরে রেখেছেন। বললেন, ‘সংসারের প্রায় সব কাজ নিজের হাতে করি। তাই জিমে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। কাজ শেষ করেই ছুটি জিমে। প্রতিদিন প্রায় দুই ঘণ্টা জিমে কাটাই। অন্য সময়টুকু পরিবারের সবার জন্য ব্যয় করলেও জিমের সময়টুকু শুধুই আমার নিজের সময়। এখন জিমে না গেলে ভালোই লাগে না। বাসায় থাকলেও ছাদে যতটুকু সম্ভব ব্যায়াম করি। স্বামীও জিমে ভর্তি হয়েছিলেন, সাত দিনের বেশি টিকতে পারেননি। তবে তাঁর সুস্থতার জন্যই তাঁকে ব্যায়াম করার পরামর্শ দিই।’
শনিবার বিকেলে জিমে বসেই শাম্মী প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। সামনে আবার প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন, তার প্রস্তুতি শুরু করেছেন। জানালেন, গতবারের চেয়ে এবার আরও বেশি ওজন বহন করতে হবে।
শাম্মীর ছোট ছেলে সাজিদ ইকবাল চীন থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বিয়ে করেছেন। বউ মির্জা সুপর্ণা কানাডায় পড়াশোনা করছেন। সাজিদ বললেন, ‘আমরা আম্মুকে নিয়ে খুব গর্ব করি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন বয়স কোনো বিষয় নয়। আমি ফুটবল খেলে দেশ–বিদেশে বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছি। ফিট থাকার জন্যই আমার সঙ্গে জিমে যাওয়া শুরু করেছিলেন মা। আমি জিম ছেড়ে দিলেও মা ছাড়েননি। তারপর তো মা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হলেন।’
শাম্মীর বড় ছেলে তানভীর ফয়সল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। একমাত্র মেয়ে হৃদিশা মৌরিন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
জিম শুরু করা প্রসঙ্গে শাম্মী বললেন, ‘ডাক্তার জানালেন ডায়াবেটিসের হলুদ বাতি জ্বলছে। লাল বাতি জ্বলতে সময় লাগবে না। হাঁটুব্যথা, গোড়ালি ব্যথাসহ অন্যান্য সমস্যাও শুরু হয়েছিল। ছেলের সঙ্গে জিমে গিয়ে ব্যায়াম করা শুরু করি। আমার এনার্জি লেভেল খুব ভালো। ওজন তোলা দেখে জিমের মালিক কাজী এবাদত হোসেন নিজেই উৎসাহ দেন। পাওয়ারলিফটিং অ্যাসোসিয়েশনে নাম নিবন্ধন করিয়ে দেন। তারপর প্রথম প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ভালোই করেছিলাম, তবে প্রথম তিন বা পাঁচজনের মধ্যে থাকতে পারিনি। গত বছর অংশ নিয়ে তৃতীয় হই। তখন অবশ্য আমি ভালো করব, তা প্রত্যাশার মধ্যেই ছিল।’
পিরোজপুরের মেয়ে শাম্মী বললেন, ‘জিমে এবং অ্যাসোসিয়েশনে প্রায় সবাই আমাকে মায়ের মতো ভালোবাসে, সম্মান করে। আমিও সবার সঙ্গে খুব আন্তরিক ব্যবহার করি।’
এসএসসি পাস শাম্মী কিশোরী বয়সেই পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলেন শামসুল হককে। জানালেন, পরিবার মেনে নেয়নি বলে এমনও দিন গেছে, এক বাটারবান দুজন খেয়ে দিন পার করেছেন। তিনি আরও বললেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার মনোবল আর সাহস খুব বেশি। সাঁতরে নদী পার হতে পারি। কষ্ট হবে ভেবে স্বামী চেয়েছিলেন সন্তানদের জন্ম অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হোক, তবে আমি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তিন সন্তানের জন্ম দিয়েছি। বড় ছেলের বয়স ২৭ বছর। ছেলের বয়সী মেয়েদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে বলে পিছিয়ে যাইনি।’
শাম্মী জানালেন, জিম শুরু করে সেই যে ডায়াবেটিসকে দাবড়ানি দিয়েছিলেন, তা আর ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেনি। শরীরের সব ব্যথা উধাও হয়ে গেছে। ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল বলে ছোট ছেলেকে আগে বিয়ে করিয়েছেন। বললেন, ‘আমরা পরিবারের সবাই বন্ধুর মতো। বিশেষ করে ছেলেদের সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক।’
পাওয়ারলিফটিংয়ের শুরুর দিকে পাড়া–প্রতিবেশীরা একেবারেই যে কথা বলেনি তা নয়। তবে শাম্মী বললেন, ‘আগে মহল্লায় মেয়ে হিসেবে সন্ধ্যার পর হাঁটা যেত না। আর এখন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে জিম করছে। চারপাশের মানুষের মনমানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে। যেকোনো বয়সী মেয়ে বা নারীদের যেকোনো কাজের জন্য ইচ্ছাশক্তি, মনোবল আর পরিবারের সহায়তা—এই তিনটাই সব থেকে জরুরি প্রয়োজন।’
২০১৮ সালে বাংলাদেশে পাওয়ারলিফটিং খেলাটি শুরু করেন বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মোমিনুল হক। তিনি জানালেন, করোনার আগে অ্যাসোসিয়েশনের দেড় শ খেলোয়াড়ের মধ্যে নারী ছিলেন ৩০ জনের মতো। দুই থেকে তিনজনের বয়স ৪০ বছর বা তার বেশি। বললেন, শাম্মী নাসরিন ২০১৯ সালে প্রথম প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তার পরের বছর বিজয়ী হলেন। ২০১৯ সালে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন শায়লা শিমু, তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর।
শাম্মী প্রসঙ্গে মোমিনুল হক বলেন, ‘তিনি খুব কম সময়ে নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছেন। এ খেলায় শারীরিক শক্তির সঙ্গে মানসিক শক্তিও প্রয়োজন যা শাম্মীর পুরোপুরি আছে। ঘাড়ে, বুকে বা মাটি থেকে ওজন তোলার জন্য বুদ্ধিমত্তারও প্রয়োজন। শুধু নিজে খেললেই হয় না, অন্য প্রতিযোগীরা কোন কৌশল প্রয়োগ করছেন, তা–ও দেখতে হয়।’
শাম্মী এবং শায়লা শিমুর স্বামীর প্রসঙ্গ তুলে মোমিনুল হক বললেন, তাঁরা স্ত্রীদের খেলার সময় বসে থাকেন, স্ত্রীকে খাওয়ার জন্য সালাদ এগিয়ে দেওয়াসহ সার্বিক সহায়তা করেন।
মোমিনুল হক জানালেন, অ্যাসোসিয়েশনটিকে ফেডারেশন করার জন্য সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এখন প্রতিযোগীরা বিভিন্ন জিমে প্র্যাকটিস করে পরে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। সরকারের অনুমোদন পাওয়া গেলে পাওয়ারলিফটিং খেলোয়াড়দের জন্যই আলাদা একটি জিম গড়ে তোলা হবে।
মোমিনুল হক অ্যাসোসিয়েশনের ফেসবুকে শাম্মীকে নিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া প্রসঙ্গে বললেন, ‘শাম্মীকে দেখে অনেক নারী এ খেলায় এগিয়ে আসার জন্য সাহস পাবেন।’