তাঁদের লাশ হিমঘরে বছরের পর বছর

  • এক বাংলাদেশির মরদেহ হাসপাতালের হিমঘরে সাত বছর ধরে।

  • যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিকের মরদেহ তিন বছর এবং দক্ষিণ আফ্রিকার এক নাগরিকের মরদেহ পাঁচ বছর ধরে পড়ে আছে।

লাশ।

২০১৪ সালের ২৬ জুন রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে মারা যান এক ব্যক্তি। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হাবিবা আক্তার নামের এক নারীর দাবি, তাঁর নাম রাজীব চৌধুরী। তিনি ধর্মান্তরিত মুসলমান। তাঁর আগের নাম খোকন নন্দী। তবে ওই ব্যক্তির প্রথম স্ত্রী মীরা নন্দীর দাবি, খোকন ধর্মান্তরিত হননি। পরে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু এখনো বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় ওই ব্যক্তির মরদেহ এখনো পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হিমঘরে।

শুধু ওই ব্যক্তিই নন, ঢাকা মেডিকেলের হিমঘরে যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিকের মরদেহ পড়ে আছে তিন বছর এবং দক্ষিণ আফ্রিকার এক নাগরিকের মরদেহ পাঁচ বছর ধরে পড়ে আছে।

একজনের মরদেহের দাবিদার দুই নারী। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সহকারী সেকান্দার আলী প্রথম আলোকে বলেন, এখানে মাত্র পাঁচটা ডিপ ফ্রিজ আছে। মরদেহ সংরক্ষণ করা যায় ২০টি। এর মধ্যে এই ৩টি মরদেহ দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। এমনও সময় আসে, মরদেহ রাখার জায়গা হয় না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. টিটো মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে বছরের পর বছর মরদেহ হিমঘরে পড়ে থাকার বিষয়টি দুঃখজনক। শিগগিরই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বারডেম হাসপাতালে মারা যাওয়া ব্যক্তির মরদেহের দুজন দাবিদার হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। পরে ঢাকার সহকারী জজ আদালত ওই ব্যক্তির মরদেহ সংরক্ষণের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর মরদেহটি গ্রহণ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে মরদেহের দাবি নিয়ে করা মামলাটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

হাবিবা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সাত বছর ধরে তিনি ঘুরছেন, কিন্তু এখনো মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। তিনি বলেন, খোকন ১৯৮০ সালের ২ এপ্রিল প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হলফনামার মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁকে বিয়ে করেন ১৯৮৪ সালের ১৫ জুলাই। তবে মীরা নন্দীর আইনজীবী কিশোর কুমার বসু রায় চৌধুরী বলেন, খোকনের প্রকৃত নাম রণজিৎ নন্দী ওরফে খোকন নন্দী। মৃত্যুর আগপর্যন্ত মীরা ও খোকন নন্দী মোহাম্মদপুরে বসবাস করতেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রবার্ট মাইরন বার্কার ২০০৫ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি হয়ে বাংলাদেশে আসেন। এক বছর পর উত্তরার একটি কমিউনিটি হাসপাতালে মাজেদা বেগম নামের একজন নারীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরে ২০১৪ সালে মাজেদাকে বিয়ে করেন তিনি। চার বছর পর হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে দক্ষিণখান এলাকার একটি হাসপাতালে ২০১৮ সালের ২৫ মে মারা যান রবার্ট বার্কার। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। বিদেশি নাগরিক হওয়ায় তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় দক্ষিণখান থানায় একটি জিডি হয়। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ হিমঘরে রাখা হয়।

মাজেদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী রবার্ট বিদেশি নাগরিক হওয়ায় তাঁর লাশ কবর দিতে পারিনি। আমি রবার্টের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। তবে সফল হইনি।’

দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিকদার মো. শামীম হোসেন বলেন, রবার্টের মরদেহ বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। দ্রুত বিষয়টির সুরাহা হবে বলে আশা করছেন।

এদিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের হাসানুজ্জামান একসময় দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক থিইসিয়া সিকেওয়েস্টের পরিচয় হয়। পরে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে থিইসিয়া ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হাসানুজ্জামানকে বিয়ে করেন। তিনি নতুন নাম ধারণ করেন তিশা জামান। বিয়ের পর তিনি বাংলাদেশে আসেন ২০১৫ সালে। এক বছর পর ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় বিষ পানে আত্মহত্যা করেন তিনি। এ ঘটনায় হাসানুজ্জামানের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়। তিশার মরদেহ রাখা হয় ঢাকা মেডিকেলের হিমঘরে।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি শুভ্র রাজ চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ওই নারীর মরদেহ মর্গে পড়ে থাকার বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ প্রশাসনের নজরে আনবেন।