বড় বড় প্রকল্পে জোর, পরিবহন ব্যবস্থাপনায় নয়। রাজধানীতে যানবাহনের গড় গতি নেমেছে ঘণ্টায় ৪.৮ কিলোমিটারে।
ঢাকার মতিঝিলে একটি ব্যবসায়িক সংগঠনের কার্যালয়ে চাকরি করেন আবুল হাসান ফজলে রাব্বি। বাসা মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনে। তিনি জানান, বাসে সকাল সাতটায় মিরপুর থেকে রওনা দিলে মতিঝিল পৌঁছাতে এখন আড়াই ঘণ্টার মতো সময় লাগে। ফিরতেও মোটামুটি আড়াই ঘণ্টা।
গুগল ম্যাপ বলছে, মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন থেকে মতিঝিলের দূরত্ব ১২ কিলোমিটারের মতো। এ পথটুকুতে যাতায়াতে দৈনিক ফজলে রাব্বিকে পাঁচ ঘণ্টা কাটাতে হচ্ছে রাস্তায়। তা–ও লক্কড়ঝক্কড় বাসে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৯ সালে যখন চাকরিতে যোগ দিই, তখন ৪০ থেকে ৫০ মিনিটেই অফিসে চলে যেতে পারতাম। এখন তিন গুণ সময় লাগছে।’
ফজলে রাব্বির এ দাবি মিলে যায় বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবের সঙ্গে। তারা বলছে, ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। অর্থাৎ দেড় দশকে ঢাকায় যানবাহন চলাচলের গড় গতি কমে গেছে ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটারের মতো। সব মিলিয়ে ঢাকার সড়ক দিন দিন নিশ্চল হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
২০০৯ সালে যখন চাকরিতে যোগ দিই, তখন ৪০ থেকে ৫০ মিনিটেই অফিসে চলে যেতে পারতাম। এখন তিন গুণ সময় লাগছে।আবুল হাসান ফজলে রাব্বি, চাকরিজীবী
করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সড়কে যানবাহন কম ছিল, যানজট সহনীয় ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীর ক্লাস শুরু হওয়া এবং রমজান মাসকে ঘিরে যানজট বেড়েছে। এ যানজটের মধ্যে চাকরিজীবী ফজলে রাব্বি বাধ্য হয়ে প্রতিদিন যে পাঁচ ঘণ্টা সড়কে কাটান, তার আর্থিক মূল্য রয়েছে। বুয়েটের এআরআইয়ের হিসাবে, এখন যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে বছর শেষে যানজটে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ২০১৮ সালে যানজটে দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা ক্ষতি হয়েছিল। তখন এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তীব্র গরম অথবা জলজট, গাড়ির ভেঁপুর কান ফাটানো শব্দ ও ধুলাবালুর মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে যাত্রীদের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ও মানসিক চাপ তৈরি হয়। সেখান থেকে শরীরে নানান রোগও বাসা বাঁধে।
যানজটের বিষয়ে বুয়েটের এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক হাদীউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা এখন ক্যানসারের রোগীতে পরিণত হয়েছে। এর হৃৎস্পন্দন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। অবস্থার পরিবর্তন না হলে এ শহরকে সচল রাখা যাবে না। তিনি বলেন, ঢাকার রাস্তায় এখন ধারণক্ষমতার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ যানবাহন চলছে। এসব যানবাহনের বড় অংশই গণপরিবহন নয়।
বুয়েটের এআরআইয়ের হিসাবে, এখন যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে বছর শেষে যানজটে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ২০১৮ সালে যানজটে দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা ক্ষতি হয়েছিল। তখন এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
সরকারি সংস্থার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে যানজটের বড় কয়েকটি কারণ জানা যায়। সেগুলো হলো: ১. ঢাকার মানুষের যাতায়াতের সবচেয়ে বড় ভরসা বাস-মিনিবাস। বাস চলাচলে শৃঙ্খলা আনার ওপর জোর না দেওয়া। ২. ইচ্ছেমতো যানবাহনের নিবন্ধন দেওয়া। ৩. ঢাকায় বিভিন্ন গতির ১৮ ধরনের বাহনের চলাচল, যা শৃঙ্খলা আনার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে। ৪. বড় বড় প্রকল্প নিয়ে সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারা। ৫. ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক পদ্ধতির অভাব এবং ৬. সরকারি কার্যালয় ও সেবা, বেসরকারি খাতের মানসম্মত সেবা বিকেন্দ্রীকরণ করতে না পারা।
সরকারি হিসাবে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ২ শতাংশই বাস করে ঢাকায়, যা এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। চীনের বৃহত্তম শহর সাংহাইয়ে ওই দেশের জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ বাস করে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধান কোনো শহরেই জনসংখ্যার ২ শতাংশের বেশি বাস করে না।
২০০৫ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) অনুমোদন করে সরকার। এর বাস্তবায়ন সময়সীমা ধরা হয় ২০২৫ সাল পর্যন্ত। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার ২০১৪ সালের সমীক্ষা বলছে, ঢাকায় দরকারি যাতায়াত বা কাজে যাওয়ার জন্য ৬০ শতাংশ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করে। আর গণপরিবহন ব্যবহারকারীদের ৬৭ শতাংশ ব্যবহার করে বাস-মিনিবাস।
২০১১ থেকে ২০২১ সময়ে রাজধানীতে মোটরসাইকেল বেড়েছে প্রায় আট গুণ। সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ লাখে। একই সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বর্তমানে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৮০৯টি, যা ২০১০ সালে ছিল ১ লাখ ৭৮ হাজার।
২০০৫ সালের কৌশলগত পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব, যাত্রীদের যানবাহন ব্যবহারের প্রবণতা ও যানজট বিবেচনায় নিয়ে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বা বিশেষ পদ্ধতিতে বাস পরিচালনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এটা করা গেলে এক বাসের সঙ্গে অন্য বাসের প্রতিযোগিতা থাকত না। কিন্তু ১৭ বছরেও বাসের ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থা চালু হয়েছে শুধু একটি রুটে।
ঢাকায় গত এক দশকে বাস-মিনিবাসের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল বেড়েছে অনেক বেশি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১১ থেকে ২০২১ সময়ে রাজধানীতে মোটরসাইকেল বেড়েছে প্রায় আট গুণ। সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ লাখে। একই সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বর্তমানে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৮০৯টি, যা ২০১০ সালে ছিল ১ লাখ ৭৮ হাজার।
একই সময়ে ডাবল ও সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ। এ যানবাহনগুলোকে যাত্রী পরিবহনকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু ঢাকায় তা যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত হয়।
দেখা যাক বাস কতটা বেড়েছে। বিআরটিএর হিসাবে, ২০১০ সালে ঢাকায় বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৩১৩। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৪৮৪টিতে। অর্থাৎ বাসও দ্বিগুণ হয়েছে। খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত এক দশকে চীন ও ভারত থেকে বেশ কিছু নিম্নমানের বাস এসেছে। এর মধ্যে সিএনজিচালিত বাসগুলো কয়েক বছরের মধ্যেই অকেজো হয়ে গেছে, যা আসলে সড়কে নেই। আর ঢাকা থেকে নিবন্ধন নেওয়া অনেক বাস দূরপাল্লার পথে চলাচল করে। এখন ঢাকা ও এর আশপাশে চলাচল করে বড়জোর ১০ হাজারের মতো বাস।
ঢাকায় সাড়ে ২০ হাজারের মতো সিএনজিচালিত অটোরিকশার নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। যদিও রাজধানী ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরের চাহিদার সঙ্গে তা অপ্রতুল বলে মনে করা হয়।
রাজধানীর কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে মেট্রোরেলের পাঁচটি লাইন, দুটি বাস র্যাপিড ট্রানজিট রুট (বিআরটি), তিনটি রিং রোড, আটটি রেডিয়াল রোড, ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে, ২১টি পরিবহন হাব, ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথের আধুনিকায়ন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা, বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি এবং পথচারী অগ্রাধিকার কৌশল ঠিক করার কথা বলা হয়েছে।
সরকার শুরুতে উড়ালসড়ক ও মেট্রোরেলে বেশি জোর দিয়েছে। কিন্তু কোনো প্রকল্পই সময়মতো বাস্তবায়িত হয়নি। এর ফলে ব্যয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নগরবাসীর দুর্ভোগ বেড়েছে। সড়ক পরিবহন, স্থানীয় সরকার ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে ঢাকায় প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা খরচ করে উড়ালসড়ক নির্মাণ করেছে। দুই হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করে হাতিরঝিল উন্নয়ন করা হয়েছে। ট্রাফিকবাতি কেনা, ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণে ২০০ কোটি টাকা খরচ করেও তা কাজে লাগছে না।
ঢাকায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পথে মেট্রোরেল, বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত উড়ালসড়ক, জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বাসের বিশেষ লেন নির্মাণ, পূর্বাচলে সড়ক ও ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন—এসব প্রকল্প চলমান আছে। এগুলোর পেছনে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। কাজ শুরুর অপেক্ষায় আছে আরও এক লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের বিভিন্ন সড়ক ও উড়ালসড়ক প্রকল্প। পাঁচটি মেট্রোরেল ও সাবওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনাও সরকারের আছে।
কিন্তু ঢাকায় বাস বাড়ানো, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা, ঢাকা ঘিরে রিং রোড নির্মাণ, ঢাকার ভেতরে সড়ক সম্প্রসারণ—এসব বিষয় অগ্রাধিকার পায়নি।
ঢাকা আগে থেকেই বসবাসের যোগ্যতাহীনতা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, অল্প জায়গায় বেশি মানুষের বাস ও নিরাপত্তার ঘাটতি—এসব নেতিবাচক দিক দিয়ে বিশ্বে বড় শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানেই রয়েছে। এ বিষয়ে গত ২৯ মার্চ রাজধানীর একটি হোটেলে পাতালরেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এ অবস্থা দেখতে তাঁর খারাপ লাগে, লজ্জা লাগে।
এর পাঁচ দিন পর জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক সড়কে অব্যবস্থাপনার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ওবায়দুল কাদের ‘টোটালি ফেইল’ (সম্পূর্ণ ব্যর্থ)।