পোশাক কারখানার কর্মী শফিক মিয়া। পবিত্র শবে বরাতের ছুটিতে (২৯ মার্চ) গ্রামের বাড়ি গিয়ে স্ত্রী-কন্যাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। স্বপ্ন ছিল, এক কক্ষের ছোট বাসা ভাড়া নিয়ে কষ্ট করে হলেও স্ত্রী ও সন্তানকে নিজের সঙ্গে রাখবেন।
কিন্তু শফিক মিয়াকে ফিরে যেতে হচ্ছে গ্রামে। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী-সন্তানও। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ৫ এপ্রিল সরকার লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার পরই শফিকের পোশাক কারখানার কোয়ালিটি অপারেটরের চাকরিটা চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে শহরের অনিশ্চিত জীবন ফেলে বিষণ্ন মুখে শফিকেরা ফিরছেন গ্রামের বাড়ি।
শফিক মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘কত স্বপ্ন নিয়া বউ-বাচ্চাকে ঢাকায় আনছিলাম! লকডাউনে আমার চাকরিই চলে গেছে। তাই উপায় না দেখে গ্রামে ফিরে যাচ্ছি।’ কারখানায় বেতনের পাওনা টাকার জন্য এত দিন অপেক্ষা করেছিলেন বলেও জানান তিনি।
শুধু শফিক মিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যরাই নয়, এমন অনিশ্চয়তায় শত শত মানুষ গাবতলীর বাস টার্মিনাল এলাকায় গিয়ে ভিড় করছেন। কীভাবে যাবেন, কত ভাড়া লাগবে, আদৌ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন কি না—এমন নানা প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। তবু প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে বাড়িফেরা মানুষের দর–কষাকষি চলছেই।
সিরাজগঞ্জের দুই ভাই রিপন আলী ও পলাশ আলী। কেরানীগঞ্জে থেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। করোনার কারণে তাঁদের কাজ বন্ধ রয়েছে। আয়-উপার্জন নেই। তাই বাড়ি চলে যাচ্ছেন।
রিপন আলী বলেন, ‘লকডাউনের পর থেকেই কাজ নাই, কামাইও নাই। তাই গ্রামে চলে যাচ্ছি। যদি সেখানে কোনো দিনমজুরের কাজ জোটে, তাহলে অন্তত খাওয়ার টাকা জোগাড় হবে।’
শনিবার বেলা ১১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা ধরে দুজনে মিলে মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলে যাওয়ার অনবরত চেষ্টা করতে থাকেন। এভাবে চেষ্টার পর একপর্যায়ে অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে হতাশ হয়ে ফুটপাতে বসে পড়েন দুজনেই।
পলাশ আলী বলেন, সাধারণত বাসভাড়া ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। কিন্তু প্রাইভেট কারে জনপ্রতি এক হাজার টাকা চাইছে। আর মোটরসাইকেলের চালকেরা ৯০০ টাকা চায়।
লকডাউনের কারণে আয় বন্ধ হওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ কিংবা ঈদকে কেন্দ্র করে ঘরে ফেরা লোকজনই নয়, দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়ছেন ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসা দরিদ্র লোকজনও। চিকিৎসা নিতে এসে কিংবা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরতে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে।
এমন একজন টাঙ্গাইলের গোপালপুরের মির্জা তোতা। শ্যামলীতে একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পায়ের হাড়ের অস্ত্রোপচার শেষে বাড়ি ফিরতে গাবতলীতে যান। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তপ্ত রোদের মধ্যে গাবতলী ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। স্ত্রী রাজিয়া বেগমও ব্যাগপত্র নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তোতার ছোট ভাই মির্জা রসিদ আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন অটোরিকশা ঠিক করতে। কিন্তু ভাড়া চাওয়া হয় অনেক বেশি।
মির্জা তোতা বলেন, চন্দ্রা পর্যন্ত যেতে পারলেও হতো। কিন্তু এক-দেড় হাজার ভাড়া চাইছে। চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হয়েছে। হাতে এত টাকা নেই বলেও জানান তিনি।
শনিবার সকালে সরেজমিন দেখা যায়, গাবতলী বাস টার্মিনালের সামনে থেকে গাবতলী-আমিনবাজার সেতু পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় মানুষের জটলা। কোথাও যাত্রীরা এক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কোনো বাহন পাওয়ার আশায়। কোথাও আবার ব্যক্তিগত গাড়ির চালক ও মোটরসাইকেলচালকেরা যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কেউ গেলেই চালকেরা গন্তব্য কোথায়, তা জিজ্ঞেস করছেন।
পাটুরিয়া কিংবা আরিচা ঘাট পর্যন্ত মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারে করে ৪০০-৫০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। মোটরসাইকেলেও ভাড়া প্রায় একই। দর-কষাকষিতে ভাড়া কমবেশি হচ্ছে। পাবনা, ফরিদপুর ও যশোর জেলাগুলোর জন্য জনপ্রতি ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং রাজশাহী, বগুড়া ও রংপুরের যেতে নেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা।
গ্রামে গুরুতর অসুস্থ মাকে দেখতে যেতে বোন ও ভাবিকে নিয়ে গাবতলী টার্মিনাল এলাকায় বসে ছিলেন রাজশাহী সদরের বাসিন্দা সিজু আহমেদ। অনেক চেষ্টা করেও কমের মধ্যে কোনো গাড়ি পাচ্ছেন না বলে জানান তিনি।
সিজু আহমেদ বলেন, এপ্রিল মাসের শেষেও অসুস্থ মাকে দেখতে বাড়ি গিয়েছিলেন। তখন একটি মাইক্রোতে অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করে গিয়ে তাঁর ১ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়েছিল। এবার ভাবি ও বোন থাকায় একটি প্রাইভেট কার রিজার্ভ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু চালকেরা ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা ভাড়া চাইছেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।