দুই সিটির কবরস্থান

ঢাকায় সাড়ে ৩ হাত মাটি পাওয়াও কঠিন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

টাকা থাকলে ঢাকায় আজীবনের জন্য জায়গা বা ফ্ল্যাট কেনা যায়। কিন্তু মৃত্যুর পর কবরের জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গা স্থায়ীভাবে কেনার সুযোগ নেই। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কবরস্থানগুলোতে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। তবে এ ব্যবস্থাও খুবই সীমিত। এ ক্ষেত্রে ২৫ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে চাইলে এলাকাভেদে সর্বনিম্ন ২০ লাখ এবং সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে হবে।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানস্বল্পতার কারণে কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা সীমিত। বিদ্যমান কবরস্থানগুলোতে জায়গা বাড়ানোর উপায় নেই। এ জন্য চাইলেই তাঁরা যে কাউকে কবর সংরক্ষণ করার সুযোগ দিতে পারছেন না। তবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সুপারিশ থাকলে কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর তাঁদের কবর ১০ বছরের জন্য বিনা মূল্যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে কবরস্থান আছে নয়টি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অধীনে রয়েছে তিনটি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় আছে ছয়টি কবরস্থান। দক্ষিণের কবরস্থানগুলো হলো আজিমপুর কবরস্থান, জুরাইন (মুরাদপুর, ধলপুরসহ) কবরস্থান ও খিলগাঁও কবরস্থান। আর উত্তরের কবরস্থানগুলো হলো রায়েরবাজার বধ্যভূমিসংলগ্ন কবরস্থান, বনানী কবরস্থান, উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কবরস্থান, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থান, উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থান এবং মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান।

দক্ষিণে সংরক্ষণের জায়গা নেই

দক্ষিণ সিটির চারটি কবরস্থানের মধ্যে একটিতেও নতুন করে কবর সংরক্ষণের জায়গা নেই। এর মধ্যে ৩৫ একর আয়তনের আজিমপুর কবরস্থানে সংরক্ষিত কবরের জন্য জায়গা বরাদ্দ ছিল সাড়ে তিন একর। সেখানে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৬০০টি কবর সংরক্ষিত আছে। আজিমপুর কবরস্থানের পাশেই আড়াই একর জায়গার ওপর আরেকটি কবরস্থান আছে। এটি আজিমপুর নতুন কবরস্থান হিসেবে পরিচিত। সেখানে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫০টি কবর সংরক্ষণ করা হয়েছে। জুরাইন (ধলপুর, মুরাদপুরসহ) কবরস্থানের আয়তন ১৮ দশমিক ২৩ একর। এই কবরস্থানে সংরক্ষিত জায়গায় ইতিমধ্যে ২ হাজার ৭০০টি কবর সংরক্ষিত আছে। আর খিলগাঁও কবরস্থানে সাধারণ মানুষের জন্য কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই।

করপোরেশনের মালিকানাধীন চারটি কবরস্থানের একটিতেও এখন আর কবর সংরক্ষণের জায়গা নেই। তবে যাঁরা কবর সংরক্ষণ করেছেন, তাঁদের স্বজনেরা চাইলে সংরক্ষিত কবরের ওপর কবর দিতে পারবেন। অবশ্য মেয়র বিশেষ বিবেচনায় কাউকে অনুমতি দিলে সাধারণ কবরকে সংরক্ষণ করে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। অবশ্য গত চার মাসে কাউকে এই সুযোগ দেওয়া হয়নি।
দক্ষিণ সিটির উপ–সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা লুৎফর রহমান

দক্ষিণ সিটির উপ–সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করপোরেশনের মালিকানাধীন চারটি কবরস্থানের একটিতেও এখন আর কবর সংরক্ষণের জায়গা নেই। তবে যাঁরা কবর সংরক্ষণ করেছেন, তাঁদের স্বজনেরা চাইলে সংরক্ষিত কবরের ওপর কবর দিতে পারবেন। অবশ্য মেয়র বিশেষ বিবেচনায় কাউকে অনুমতি দিলে সাধারণ কবরকে সংরক্ষণ করে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। অবশ্য গত চার মাসে কাউকে এই সুযোগ দেওয়া হয়নি।

উত্তরে জায়গা আছে, দাম বেশি

উত্তর সিটির ছয়টি কবরস্থানের মধ্যে দুটি কবরস্থানে কবর সংরক্ষণ করতে চাইলে মোটা অঙ্কের টাকা লাগছে। তবে এই সুযোগ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি বা সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নেকনজর থাকলেই সম্ভব হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সংস্থাটির সমাজকল্যাণ বিভাগ সূত্র বলছে, উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থান এবং বনানী কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে চাইলে ২৪ লাখ টাকা এবং ২৫ বছরের জন্য ৪৫ লাখ টাকা খরচ পড়বে। বর্তমানে এই দুটি কবরস্থানেও কবর সংরক্ষণের জায়গা খুব সীমিত। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত কবর সংরক্ষণের জন্য আবেদন করেছেন ৩০ জন। এর মধ্যে উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের জন্য ২টি এবং বনানী কবরস্থানের জন্য ২২টি আবেদনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

বনানী ও উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের কবরস্থানে কবর সংরক্ষণের জন্য জায়গার পরিমাণ খুবই কম। তুলনামূলক বেশি জায়গা আছে রায়েরবাজার বধ্যভূমিসংলগ্ন কবরস্থানে
উত্তর সিটির সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান

উত্তর সিটির বাকি ৪টি কবরস্থানে কবর সংরক্ষণ করতে চাইলে ১৫ বছরের জন্য ৬ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ১১ লাখ টাকা খরচ পড়বে।

উত্তর সিটির সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বনানী ও উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের কবরস্থানে কবর সংরক্ষণের জন্য জায়গার পরিমাণ খুবই কম। তুলনামূলক বেশি জায়গা আছে রায়েরবাজার বধ্যভূমিসংলগ্ন কবরস্থানে।

মৃত্যু বেশি দক্ষিণে

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। সংস্থা দুটির সমাজকল্যাণ বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দক্ষিণের ৪টি কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়েছে ৭ হাজার ৭০৯টি। অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬টি কবরস্থানে গত ৭ মাসে লাশ দাফন হয়েছে ৩ হাজার ৭৮৫টি। উত্তরের তুলনায় দক্ষিণে প্রায় দ্বিগুণ লাশ দাফন হয়েছে। এই সাত মাসে লাশ দাফন ব্যবস্থাপনা বিনা মূল্যে করেছে দক্ষিণ সিটি। আর প্রতি দাফনে ৫০০ টাকা করে নিয়েছে উত্তর সিটি।

ফি বাড়িয়েছে দক্ষিণ

কবর সংরক্ষণ নিরুৎসাহিত করতেই ফি বাড়ানো হচ্ছে
উপ–সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা লুৎফর রহমান

সংরক্ষিত কবরের জন্য জায়গা না থাকলেও এই খাতে কয়েক গুণ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএসসিসি। গত ৭ জুলাই সংস্থাটির দ্বিতীয় বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে সংস্থাটির মালিকানাধীন কবরস্থানে ১০ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে চাইলে দিতে হবে ৫ লাখ টাকা। ১৫ বছরের জন্য দিতে হবে ১০ লাখ টাকা। আগে ১০ বছরের জন্য ৩ লাখ এবং ১৫ বছরের জন্য ৬ লাখ টাকা দিতে হতো। এ ছাড়া ২০ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে হলে এখন থেকে ১৫ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ২০ লাখ টাকা খরচ করতে হবে। আগে ২০ বছরের জন্য ৯ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ১২ লাখ টাকা নির্ধারিত ছিল।

জায়গা না থাকার পরও ফি বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে সংস্থাটির উপ–সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কবর সংরক্ষণ নিরুৎসাহিত করতেই ফি বাড়ানো হচ্ছে।

আগে কতো খরচ হতো

দুই যুগ আগেও ১৯৯৬ সালে বনানী এবং উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে স্থায়ীভাবে কবরের জন্য জায়গা কেনা যেত। তখন সাড়ে তিন হাত জায়গা স্থায়ীভাবে কিনতে খরচ হতো এক লাখ ২০ হাজার টাকা। আর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে জায়গা কেনা যেত ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকায়। ২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত টাকার পরিমাণ একই ছিল।

২০০৫ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কবরের জন্য স্থায়ী জায়গা কেনা বন্ধ হয়ে যায়। এর পর ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন মেয়াদে কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু হয়। এই ব্যবস্থাই এখনো চলছে।

আর সত্তর থেকে আশির দশকে ঢাকায় মাত্র এক থেকে দেড় হাজার টাকায় একটি কবরের জন্য স্থায়ীভাবে জায়গা কেনা যেত বলে জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটির উপ-সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের পুরোনো নথিপত্রে দেখা গেছে, মানুষ এক থেকে দেড় হাজার টাকা চালানের মাধ্যমে একটি কবরের জন্য জায়গা কিনেছেন।

সাধারণ মানুষের জন্য কবরের জায়গা নেই

এদিকে সংরক্ষণের জায়গা বাদে কবরস্থানগুলোতে সাধারণ মানুষের কবরের ওপর প্রতিনিয়তই নতুন করে কবর দিতে হচ্ছে। রায়েরবাজার বধ্যভূমিসংলগ্ন কবরস্থান বাদে দুই সিটির বেশির ভাগ কবরস্থানেরই এখন এই অবস্থা। রাজধানীর আয়তন ও জনসংখ্যার তুলনায় কবরস্থানের জায়গা কম।

কবরের ওপর কবর দেওয়ার বিষয়ে কোরআন ও হাদিসে সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমার কথা উল্লেখ নেই। তবে একটি মরদেহ মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর সেখানে আরেকজনকে দাফন করা যাবে
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গ্রান্ড মুফতি মো. আবদুল্লাহ

অবশ্য কবরের ওপর কবর দেওয়ার বিষয়ে ধর্মীয় কোনো বাধা নেই বলে জানান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গ্রান্ড মুফতি মো. আবদুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কবরের ওপর কবর দেওয়ার বিষয়ে কোরআন ও হাদিসে সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমার কথা উল্লেখ নেই। তবে একটি মরদেহ মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর সেখানে আরেকজনকে দাফন করা যাবে। গবেষণা করে তিনি দেখেছেন, ছয় মাসের মধ্যে মরদেহ মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এটি চার মাসেও হয়।