সরকারের খাতায় পরিবহনটির নাম ‘হিউম্যান হলার’ হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তা ‘লেগুনা’ হিসেবেই পরিচিত। সরকারি হিসেবে, রাজধানী ঢাকায় লেগুনা আছে ৪ হাজার ৭৫২টি। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। রাজধানীতে এসব লেগুনা ‘যেমন খুশি তেমন’ চলছে। ভাড়া থেকে শুরু করে স্ট্যান্ড নির্ধারণ—সবকিছুই লেগুনামালিকেরা নিজেদের ইচ্ছেমতো করেন।
অভিযোগ আছে, ট্রাফিক পুলিশ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব লেগুনার কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন। আর এ ব্যয় মেটাতে লেগুনামালিকেরা যাত্রীদের কাছ থেকে অযৌক্তিকভাবে ভাড়া আদায় করেন। কোনো কারণ ছাড়াই রাজধানীতে লেগুনার ভাড়া বাড়তে দেখা গেছে।
মাঝে ঢাকার সড়ক থেকে লেগুনা তুলে দেওয়ার ঘোষণা এসেছিল। কিন্তু এ ঘোষণা বেশি দিন কার্যকর থাকেনি। ভাড়াসহ সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় লেগুনা-সংক্রান্ত বিষয়ে অভিযোগ জানানোর সুযোগ পাচ্ছেন না যাত্রীরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, লেগুনাকে মিনিবাস হিসেবে গণ্য করে সে হিসেবে ভাড়া নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে বিআরটিএ এখন আর লেগুনার রুট পারমিট দিচ্ছে না। ভবিষ্যতে আর লেগুনা থাকবে না।
অযৌক্তিক ভাড়া
ঢাকায় যেসব রুটে বাস চলে না, মূলত সেসব রুটকেই লেগুনার জন্য বেছে নেন মালিকেরা। মারুফ হোসেন জিগাতলার বাসা থেকে কারওয়ান বাজার অফিস করেন। এ পথে কোনো বাস না থাকায় তিনি ফার্মগেট পর্যন্ত আসেন লেগুনায়। বাকিটা পথ যান হেঁটে।
মারুফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসাভাড়া বেশি বলে অফিসের কাছে বাসা নিইনি। লেগুনাতেই প্রতিদিন আসা-যাওয়া করি। দিনে খরচ পড়ছে ৫০ টাকা। মাসে প্রায় দেড় হাজার টাকা।’
লেগুনায় জিগাতলা থেকে ফার্মগেটের বর্তমান ভাড়া ২৫ টাকা। মো. মারুফ নামের এক লেগুনাচালক বলেন, এ পথে সবশেষ ভাড়া বেড়েছে সাত টাকা। আর ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর ও শংকর পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা। আগে ছিল তা ১৫ টাকা। ৮ থেকে ১০ মাস আগে এ ভাড়া বাড়ানো হয়।
জিগাতলা-ফার্মগেট রুটের প্রায় সব লেগুনাই চলে সিএনজিতে। এ রুট ছাড়াও ফার্মগেট থেকে ৬০ ফিট, আজিমপুর ট্যানারি মোড় থেকে নিউমার্কেট, নিউমার্কেট থেকে ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হল, মোহাম্মদপুর থেকে শ্যামলী—ঢাকার ভেতরে এমন অনেক রুটেই লেগুনা চলে। এসব লেগুনার অল্প কিছু ডিজেলচালিত। বাকি সব চলে সিএনজিতে।
সিএনজিতে লেগুনা চলার পরও হুটহাট ভাড়া বৃদ্ধির পাশাপাশি অযৌক্তিক অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ায় যাত্রীরা ক্ষুব্ধ। মোহাম্মদপুর থেকে শ্যামলী পর্যন্ত লেগুনায় নিয়মিত যাতায়াত করেন মোহাম্মদ মাসুম। তিনি বলেন, কয়েক মাস আগেও এ পথের ভাড়া ছিল ১০ টাকা। একলাফে তা ১৫ টাকা হয়ে গেছে।
ফার্মগেট থেকে ৬০ ফিট ও ফার্মগেট থেকে জিগাতলা রুটে চলে ঢাকা ইন্দিরা পরিবহন নামের লেগুনা। ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে লেগুনা ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন ওরফে চুন্নু প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে যাত্রী দুজন কমিয়ে নেওয়া হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণ খরচের পর প্রতি গাড়িতে মাসে খুব কম লাভ থাকে। তাই ভাড়া বাড়াতে হয়েছে।’
লেগুনামালিকেরা বলছেন, সরকার যদি ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে তাঁদের কোনো সমস্যা নেই।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘লেগুনার ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে কার্যক্রম চলছে। এ নিয়ে আমরা বিআরটিএর সঙ্গে বসতে চাচ্ছি।’
চাঁদাবাজি
ফার্মগেট থেকে জিগাতলা, আজিমপুরের ট্যানারি মোড় থেকে নিউমার্কেট ও মোহাম্মদপুর থেকে শ্যামলী—এই তিনটি রুটের অন্তত ছয় লেগুনাচালকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। প্রতিটি রুটেই চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন চালকেরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই চালকেরা বলেন, নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তির মাধ্যমে ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের পকেটে চাঁদার টাকা যায়। এ কারণে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নিতে হয়।
ফার্মগেট থেকে জিগাতলা রুটে ১১ বছর ধরে লেগুনা চালাচ্ছেন মো. মারুফ। তাঁর ভাষ্য, বর্তমানে এ রুটে গাড়িপ্রতি দৈনিক এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে।
ফার্মগেট-জিগাতলা রুটে বর্তমানে ২৯টি লেগুনা চলে বিভিন্ন মালিকের অধীন। তবে সব কটি লেগুনার নিয়ন্ত্রণ দেলোয়ারের হাতে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কমিউনিটি পুলিশকে টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া কয়েকটি জায়গায় স্থানীয়রা চাঁদা নেয়। চাঁদা নেওয়া স্থানীয় ব্যক্তিদের তিনি চেনেন না বলে দাবি করেন।
মোহাম্মদপুর থেকে শ্যামলী পর্যন্ত রুটে প্রায় অর্ধশত লেগুনা চলে। প্রতিটি গাড়ির জন্য দৈনিক ৮০০ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে জানান চালকেরা। এ পথ নিয়ন্ত্রণ করেন মিন্টু ও শাহ আলম নামের দুজন। এখানকার লেগুনার লাইনম্যান (লেগুনার সিরিয়াল দেন) মোহাম্মদ শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদা কোথায় দেওয়া হয়, তা তিনি জানেন না। এসব বিষয় মিন্টু ও শাহ আলম বলতে পারবেন।
গত মাসে দুদিন মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে মিন্টু ও শাহ আলমের বিস্তারিত পরিচয় বা ফোন নম্বর পাওয়া যায়নি। কেউ তাঁদের বিষয়ে মুখ খুলতেও রাজি হননি।
হাজারীবাগ থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত ১৭টি লেগুনা চলে। এ রুটে গাড়িপ্রতি দৈনিক ২৩০ টাকা চাঁদা দিতে হয় বলে জানান চালকেরা। মূলত মালিকদের মাধ্যমে টাকা ট্রাফিক পুলিশের কাছে যায় বলে দাবি তাঁদের।
এ রুটের লেগুনামালিকদের একজন আলী হায়দার বাচ্চু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কর্মচারী কল্যাণ সমিতি ও ট্রাফিক পুলিশকে টাকা দিতে হচ্ছে।
কিন্তু লেগুনার মালিক-চালকদের কেউই কোন পুলিশ বা স্থানীয় নেতাদের চাঁদা দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আগে ট্রাফিক পুলিশের কিছু সদস্যের চাঁদাবাজির প্রমাণ পাওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে অভিযোগ থাকলে, তথ্যপ্রমাণ থাকলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বৈধ-অবৈধ
২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তৎকালীন কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছিলেন, রাজধানী ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে আর লেগুনা চলবে না।
এরপর কয়েক দিন ঢাকার রাস্তায় লেগুনা চলতে দেখা যায়নি। কিন্তু পরে ঢাকার রাস্তায় লেগুনা ফিরে আসে।
লেগুনামালিকদের দাবি, ডিএমপির তৎকালীন কমিশনারের ওই ঘোষণার পর তাঁর সঙ্গে বসেছিলেন তাঁরা। মালিকেরা রুট পারমিট থাকার দাবি তুলে ধরলে আবার লেগুনা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, কোন ঘটনার প্রেক্ষাপটে তখন লেগুনা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তা তাঁর জানা নেই। তবে ফোর হুইলারের (চার চাকা) ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কোনো চিঠি ট্রাফিক পুলিশ পায়নি। অনুমোদিত হলে, লাইসেন্স ও রুট পারমিট থাকলে, যেকোনো চার চাকার গাড়ি চলতে পারবে।
ট্রাফিক পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পরিবহনের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আরোপ করা হয়। ছোটখাটো বিষয় হলে তখন কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। জনগণের সুবিধা, চাহিদা ও যোগাযোগ ঠিক রাখতে অনেক সময় নমনীয় থাকে ট্রাফিক পুলিশ।
বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) ও মুখপাত্র শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, গণপরিবহনের ক্ষেত্রে পুলিশের কাজ কাগজপত্র পরীক্ষা করা। পুলিশ গাড়ি নিষিদ্ধ করতে পারে না। শুধু বিআরটিএ তা পারে। ঢাকার কিছু রুটে কিছু লেগুনার পারমিট (অনুমোদন) আছে। আর কিছু লেগুনা অবৈধভাবে চলছে।