ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেট বা ফাইভ-জি সেবা চালু করতে চায় রাষ্ট্রায়ত্ত মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটক। এ সেবা চালু করতে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কাছে ২৩৬ কোটি টাকা চেয়েছে।
প্রাথমিকভাবে ঢাকার এক লাখ গ্রাহককে ফাইভ-জি সেবার আওতায় আনতে চায় টেলিটক। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে সরকারি দপ্তর ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
এ-সংক্রান্ত ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ফাইভ-জি প্রযুক্তি চালুকরণ’ প্রকল্পটি এখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
গ্রামপর্যায়ে টেলিটকের নেটওয়ার্ক বাড়ানোর পাশাপাশি ফাইভ-জি সেবা চালু করতে গত বছরের আগস্টে অপর একটি প্রকল্পে বড় অঙ্কের টাকা বরাদ্দ পায় টেলিটক।
গ্রামপর্যায়ে টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও ফাইভ-জি সেবা নেটওয়ার্ক আধুনিকায়নে নেওয়া প্রকল্পটিতে খরচ হবে ২ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বলছে, গৃহীত প্রকল্পের মাধ্যমে ফোর-জি প্রযুক্তিনির্ভর টেলিযোগাযোগ–সুবিধা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ফাইভ-জি প্রযুক্তিনির্ভর নেটওয়ার্কের প্রস্তুতি শুরু হবে। আর প্রস্তাবিত প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ফাইভ-জি সুবিধা দেওয়া হবে।
তবে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, টেলিটকের ফোর-জি সুবিধা এখনো বিভাগীয় ও জেলা শহরে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই ফাইভ-জি সেবা দেওয়া শুরুর আগে ফোর-জি সেবার আওতা আরও বাড়াতে হবে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্তত ৬০টি দেশে ফাইভ-জি সেবা চালু আছে। বাংলাদেশে বেসরকারি মুঠোফোন সেবাদাতা কোম্পানিগুলো ফাইভ-জি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার পাশাপাশি দেশীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সবার আগে দেশে ফাইভ-জি সেবা চালু করতে চায় টেলিটক।
টেলিটক থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ফাইভ-জি সেবা দিতে ঢাকায় ২০০টি বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস) বসানো হবে। সরকারি দপ্তর ও বাণিজ্যিক এলাকাকে মাথায় রেখে এগুলো বসানো হবে।
অগ্রাধিকারে থাকা এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে বঙ্গভবন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, সেনানিবাস, মতিঝিল, রমনা, শাহবাগ, ধানমন্ডি, আগারগাঁও, শেরেবাংলা নগর, মোহাম্মদপুর, বনানী, গুলশান ও উত্তরা। পাশাপাশি যেসব এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেও বিটিএস বসানো হবে।
দেশে টেলিটকের ফাইভ-জি পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। টেলিটক জানায়, ঢাকার ছয়টি এলাকায় সেসময় ফাইভ-জি সেবা চালু করা হয়।সরকারি দপ্তর ও বাণিজ্যিক এলাকাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় ও টেলিটকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে দেশে রোবোটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার বাড়বে। সারা দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় ভারী শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। হাই–টেক পার্কেও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কারখানা গড়ে উঠছে। ভবিষ্যতে বন্দর ও বিমানবন্দর এলাকায় ফাইভ-জি সেবার দরকার হবে।
আধুনিক চালকবিহীন গাড়ি, লাইভ ম্যাপ, ট্রাফিকের তথ্য জানার জন্যও ফাইভ-জি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সরকারি দপ্তরে দ্রুতগতিতে তথ্য আদান-প্রদান, ভিডিও ডাউনলোড ও আপলোডের হার বাড়বে। এসব দিক বিবেচনা করে এখন থেকেই ফাইভ-জি সেবা চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফাইভ-জি সেবা চালু করতে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঢাকা শহরের গ্রাহকদের কথা মাথায় রেখে ফাইভ-জি সেবা চালু করতে চাই। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে সরকারি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। কারণ, আগামী দিন হবে প্রযুক্তির। প্রযুক্তিতে আমরা আগে অনেক পিছিয়ে ছিলাম। এখন আর পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই।’
ফাইভ-জি সুবিধা দিতে টেলিটকের যন্ত্র ও সরঞ্জাম কেনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়।
সভায় বলা হয়, বাংলাদেশে ফাইভ-জি সেবা চালু করতে অনেক যন্ত্র ও সরঞ্জাম কিনতে হবে। বাংলাদেশে আগে কোনো মুঠোফোন সেবাদাতা কোম্পানি এ ধরনের যন্ত্র-সরঞ্জাম কেনেনি। তাই এসব যন্ত্র-সরঞ্জামের দামের তুলনা করা সম্ভব নয়।
ফাইভ-জি সেবার জন্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনাকাটা সম্পর্কে জানতে চাইলে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আমরা আশ্বাস দিতে পারি, এ প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হবে না। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হবে। যারা যোগ্য, তারাই কাজ পাবে।’
মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা বা থ্রিজি চালু হয়। ফোর-জি চালু হয় ২০১৮ সালে। তবে দেশের বেশির ভাগ মুঠোফোন গ্রাহক এখনো টুজি প্রযুক্তির সেবা গ্রহণ করছেন।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, ফাইভ-জির যন্ত্র-সরঞ্জাম স্থাপনের জন্য যেসব এলাকায় বিটিএস বসানো হবে, সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগের লোড বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিটিএস সাইটে বিদ্যুতের ট্রান্সমিশন লাইন শক্তিশালী করতে হবে।
টেলিটকের সেবা নিয়ে গ্রাহকদের আছে নানা অভিযোগ। কোম্পানিটির সেবার মান যে সন্তোষজনক নয়, তা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, টেলিটকের নেওয়া প্রকল্পগুলো থেকে সুফল মিলছে না।
আইএমইডি বলছে, টেলিটকের সেবার মান সন্তোষজনক নয়। এ প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক কাভারেজ অন্য অপারেটরদের চেয়ে অনেক কম। তা ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় টাওয়ার বিটিএসের সংখ্যা কম হওয়ায় গ্রামপর্যায়ে নেটওয়ার্কের সমস্যা থাকে। টেলিটকের ইন্টারনেট সুবিধাও ভালো নয়। নেটওয়ার্ক মাঝেমধ্যে খুবই খারাপ থাকে।