বছরে দু-একটা গরু পুষে তা ঈদুল আজহার আগে স্থানীয় ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করে দেন শেরপুর জেলার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম। যা লাভ হতো, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন নজরুল ইসলাম। তবে তাঁর এলাকার অনেককে প্রতিবছর ঢাকায় গরু নিয়ে আসেন এবং ভালো দামে বিক্রিও করে থাকেন। স্থানীয়দের দেখাদেখি নজরুল ইসলামও গত বছর ছয়টি গরু পোষেন। ভালো দামের আশায় গত সোমবার নজরুল ছয়টি গরু ট্রাকে নিয়ে ঢাকার আফতাবনগর গরুর হাটে আসেন।
আফতাবনগর হাটেই আজ বুধবার বিকেল চারটার দিয়ে কথা হলো নজরুলের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘এই প্রথমবার ঢাকায় গরু নিয়ে এলাম। কিন্তু বাজার খারাপ। গরুর পেছনে যে খরচ হয়েছে, সেই টাকাই মনে হয় উঠবে না। গরু যে পাললাম, যেভাবে দাম পাওয়ার কথা, সেভাবে দাম হলো না। আমাদের ওদিকে বন্যা হয়েছে। আমাদের ওখানে বেচাকেনা হচ্ছে না। পাইকার নেই। নিরুপায় হয়ে ঢাকায় আসলাম। এখানেও দেখি একই অবস্থা। আজ দুটি গরু বিক্রি করেছি। কিন্তু লসে।’
নজরুল বাকি চারটি গরু প্রত্যাশামতো দামে বিক্রি করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায়। জানালেন, শেরপুর থেকে ছয়টি গরু ঢাকায় আনতে তাঁর খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। গরু যদি বিক্রি না হয়, তাহলে আবারও টাকা খরচ করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
নজরুল ইসলামের মতো ঢাকায় গরু নিয়ে আসা আরও কয়েকজন বলছেন, করোনার প্রভাব এবার গরুর হাটে। অন্যান্যবারের তুলনায় এবার ঢাকার হাটে গরু কম এসেছে। ঈদের আর দুদিন বাকি থাকলেও হাটে ক্রেতার আনাগোনা কম। যদিও পুরান ঢাকার অন্য হাটগুলোর তুলনায় আফতাবনগর গরুরহাটে ভালো কেনাবেচা শুরু হয়েছে।
গরু ক্রেতাদের অভিযোগ, করোনার কারণে তাঁরা ভেবেছিলেন, এবার হয়তো গরুর দাম কম হবে। কিন্তু ঢাকায় গরু নিয়ে আসা লোকজন, অন্যান্যবারের মতো গরুর বেশি দাম হাঁকছেন।
পুরান ঢাকার ধূপখোলার মাঠ, ধোলাইখাল ও আফতাবনগর হাটে গরু কিনতে আসা অন্তত ২৫ জন গরু ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, করোনার কারণে সবাই আর্থিক সংকটে পড়েছেন। যারা আগে এককভাবে গরু কোরবানি দিতেন, এবার দিচ্ছেন ভাগাভাগি করে। এমনই একজন রামপুরার বাসিন্দা মো. মোস্তফা। আজ বুধবার বিকেলে আফতাবনগর হাটে গরু কিনতে আসেন তিনি। মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যে ভবনে থাকি, সেই ভবনে ১৮টি পরিবার আছে। প্রতিবছর তাঁরা আলাদা আলাদা করে কোরবানি দিতেন। কিন্তু করোনার কারণে এবার আটটি পরিবার কোরবানি দেবে। করোনার কারণে আর্থিক সংকটে পড়ে আমাকেও এবার ভাগে কোরবানি দিতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
হাটে গরু কম
পুরান ঢাকার ধূপখোলার মাঠে গত ১৫ বছর ধরে ঝিনাইদহ থেকে গরু নিয়ে আসেন মোহাম্মদ ফারুক। এবারও তিনি গরু নিয়ে এসেছেন এই মাঠে। ধূপখোলার মাঠে গরুর সংখ্যা কম দেখে কিছুটা অবাক ফারুক। এর আগে কখনো এত কম গরু তিনি দেখেননি।
মোহাম্মদ ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের দুদিন আগে ধূপখোলার মাঠজুড়ে গরু থাকে। কিন্তু এবার মাঠের অর্ধেকই এবার ফাঁকা। হাটে গরু উঠেছে একেবারই কম। এখন ক্রেতাও কম দেখছি। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে, ঢাকায় সাধারণত গরু বিক্রি হয় ঈদের আগেরদিন।’
বড় গরু কম
ধূপখোলার মাঠ, ধোলাইখাল ও আফতাবনগর হাট ঘুরে দেখা গেল, অন্যান্যবারের তুলনায় এবার হাটে বড় গরুর সংখ্যা কম। আবার দু-একটা বড় গরু নিয়ে এসেছেন, তাঁরাও পড়েছেন বিপাকে।
আফতাবনগর হাটে চুয়াডাঙ্গা থেকে ছয়টি বড় গরু এনেছেন ব্যাপারী এমদাদুল হক। তাঁর ছয়টি গরুর মধ্যে দুটি গরু সবার নজর কেড়েছে। এমদাদুল গরু দুটির নাম দিয়েছেন, ডন-১, ডন-২। আফতাবনগর হাটের ক্রেতাদের চোখ ওই দুটি গরুর দিকেই। সবাই গরু দেখলেও ভালো দামে বিক্রি করতে পারছেন না এমদাদুল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাকাল না হলে, দুটি গরু অনায়াসে বিক্রি করতাম ১৪ লাখ টাকায়। কিন্তু এখন এই গরুর দাম বলছে তিন লাখ টাকা। কেউ যদি চার লাখ টাকা দাম দেয়, তাহলে এই গরু আমি বিক্রি করে দেব। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
নাটোরের গুরুদাসপুর থেকে দুটি বড় গরু নিয়ে পুরান ঢাকার ধূপখোলা মাঠে এসেছেন সাবলুর রহমান। তিনি গরু দুটির দাম হাঁকছেন আট লাখ করে ১৬ লাখ টাকা। তবে ক্রেতারা গরু দুটির দাম বলছেন সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকা। সাবলুর গরু দুটির নাম দিয়েছেন, ‘বীর’ আর ‘বাহাদুর’।
সাবলুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই প্রথম আমি ধূপখোলার মাঠে ঢাকায় গরু নিয়ে এসেছি। এই মাঠের সেরা গরু আমার। কিন্তু কাস্টমার নেই। যে কাস্টমার আসতেছেন, তাঁরা দাম-দর সেভাবে করতেছেন না। যারা দর-দাম করতেছেন, তাঁরাও কম বলছেন। অনেকে আমার দুটি গরুর ছবি মোবাইলে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। যদি দুটো টাকা বেশি পাই, সে জন্যই তো ঢাকায় গরু নিয়ে এসেছি। এখন কী হবে জানি না।’