ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম এখনো শেষ হয়নি। এরই মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৩০০ ছাড়িয়েছে। মারা গেছেন অন্তত তিনজন। তাঁদের মধ্যে একজন চিকিৎসক আছেন। এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ গেল কয়েক বছরের তুলনায় বেশি উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ। এই রোগ এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণত এপ্রিল–জুন মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় সেপ্টেম্বর–অক্টোবর মাসে। এরপর ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে থাকে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, এবার কেবল জুন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭১৩ জন; যা বিগত তিন বছরের শুধু জুন মাসের তুলনায় ৫ গুণেরও বেশি। আর চলতি মাসের প্রথম চার দিনে ৩৫৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে কেবল গত বৃহস্পতিবার ১৪২ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
এ বছর সরকারি–বেসরকারি ৪৭টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তথ্য সংগ্রহ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়শা আক্তার বলেন, এবার গত কয়েক বছরের তুলনায় ঢাকা শহরের অনেক নতুন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ কারণে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি লিপিবদ্ধ হচ্ছে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বাড়ানো এবং যাতে মৃত্যু না হয়, সে বিষয়ে সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা) অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় ঘনবসতি বেশি। এখানকার পরিবেশও এডিস মশার জন্য সবচেয়ে অনুকূলে। শহর জুড়ে নির্মাণকাজ চলছে। নির্মাণকাজের এলাকায় জমে থাকা পানিতে মশা ডিম পাড়ে। এ কারণে নির্মাণাধীন এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আক্রান্ত দুজন ডেঙ্গু রোগী মারা যান। তাঁদের একজনের বয়স ৫৩ বছর। তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ এপ্রিল মারা যান। আরেকজনের বয়স ৩২ বছর। তিনি ২৮ এপ্রিল মারা যান। সর্বশেষ ২ জুলাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে।
>ঢাকার পরিবেশ ডেঙ্গুর সহায়ক
নির্মাণকাজের আশপাশে পানি জমে থাকায় এডিস মশা বেশি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তেজগাঁও, তুরাগ, পল্লবী, মগবাজার, উত্তরা, গুলশান, বনানী, কাফরুল, খিলগাঁও, রামপুরা, মিরপুর, পীরেরবাগ, মোহাম্মদপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, বনানী, গুলশান, বারিধারায় সবচেয়ে বেশি এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দয়াগঞ্জ, নারিন্দা, স্বামীবাগ, গেন্ডারিয়াসহ আশপাশের এলাকা, দক্ষিণ মুগদাপাড়া, বাসাবো, মানিকনগর বিশ্বরোড, শেরেবাংলা রোড, হাজারীবাগ, মগবাজার ও রমনা, সেগুনবাগিচা, শাহবাগ, হাজারীবাগ, ফরাশগঞ্জ, শ্যামপুর, উত্তর যাত্রাবাড়ীতে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র বেশি।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন ৭৪ জন। রামপুরার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র নিউটন রায় হাসপাতালের ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। তার মা অরুণা বিশ্বাস জানান, জ্বর নিয়ে ছেলেকে গত ৩০ জুন হাসপাতালে ভর্তি করেন। এরপর এখানকার চিকিৎসক পরীক্ষা করে ডেঙ্গু শনাক্ত করেন। তাঁদের বাসা রামপুরার উলন রোডে। সেখানে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো ওষুধ দিতে দেখেননি। বাসায়ও প্রচণ্ড মশার উপদ্রব।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, মাদারটেক ত্রিমোহিনীর পাঁচজন রোগীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, তাঁদের এলাকায় মশার উপদ্রব আছে। এলাকায় তাঁরা ওষুধ ছিটাতে দেখেননি।
অবশ্য ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেন, তাঁরা মশক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। মশক নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির পাঁচটি অঞ্চলে মশক নিধন কর্মীদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর, আবাসিক এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পাশাপাশি মসজিদের ইমাম, স্কুল–কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
রোগের ধরন, প্রকোপ ও প্রাদুর্ভাবের ওপর নজরদারি করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, এখন এডিস মশার প্রজননের মৌসুম হওয়ায় এই মশা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। এখনকার আবহাওয়াও এই মশার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্তরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এ কারণে জ্বর হলে সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গুর বেশ কিছু জটিলতা দেখা যাচ্ছে বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, আক্রান্তদের কারও পেটব্যথা বা ডায়রিয়া হলে সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। বেশি বেশি তরল খাবার দিতে হবে। আর ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে পদক্ষেপ জরুরি।