পুরো রাজধানীতেই বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এর মধ্যে ৩১টি এলাকায় সংক্রমণ বেশি। রাজধানী ঢাকায় মোট আক্রান্তের অর্ধেকের বেশি সংক্রমিত হয়েছে এই ৩১টি এলাকায়। এসব এলাকায় এখনো সংক্রমণ বাড়ছে।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ১৫ মে পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর মোট ১৮৩টি এলাকায় করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ওই ৩১টি এলাকায় সর্বনিম্ন ৪৮ থেকে সর্বোচ্চ ২২৩ জন আক্রান্ত আছেন। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে এসব এলাকায় (তিনটি বাদে) ৩৪ থেকে ৭৯ শতাংশ পর্যন্ত সংক্রমণ বেড়েছে। এর বাইরে অন্য এলাকায়ও সংক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। গত ১৫ দিনে সংক্রমণ পাওয়া গেছে নতুন ১৫টি এলাকায়।
আইইডিসিআরের হিসাবে রাজধানীতে মোট আক্রান্ত ৮ হাজার ৫৯৩ জন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৯১২ জনের এলাকাভিত্তিক তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই সংখ্যার হিসাবে আক্রান্তদের প্রায় ৬৩ শতাংশ সংক্রমিত হয়েছে ৩১ টি এলাকায়।
দেশে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার এক মাসের মাথায় ৫ এপ্রিল আইইডিসিআর দেশে পাঁচটি ক্লাস্টার (কম দূরত্বের মধ্যে অনেক রোগী) চিহ্নিত করেছিল। এর দুটিই ছিল ঢাকায়। একটি মিরপুরের টোলারবাগ, অন্যটি বাসাবো। ৫ এপ্রিল পর্যন্ত টোলারবাগে রোগী ছিল ৬ জন আর বাসাবোতে ৯ জন। ওই দিন পর্যন্ত ঢাকার ২৯টি জায়গায় সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছিল। রাজধানীতে মোট রোগী ছিল ৫২ জন। সংক্রমণ ঠেকাতে শুরু থেকে রাজধানীর যেসব জায়গায় রোগী শনাক্ত হয়েছে, সেখানে সীমিত পরিসরে ভবন বা গলি লকডাউন (অবরুদ্ধ) করা হয়। কিন্তু একমাত্র টোলারবাগ ছাড়া আর কোনো এলাকায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। দেড় মাসের ব্যবধানে সংক্রমণ এখন রাজধানীর ১৮৩টি এলাকায় ছড়িয়েছে। এর মধ্যে ১০টি এলাকা আছে, যার প্রতিটিতে ১০০ জনের বেশি আক্রান্ত রয়েছে।
ঢাকায় এখন মোট শনাক্ত হওয়া রোগী রয়েছেন ৮ হাজার ৫৯৩ জন। সারা দেশে আক্রান্তদের ৫৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ (১২ হাজার ৯২৫ জনের এলাকাভিত্তিক তথ্যের হিসাবে) রোগী রাজধানী ঢাকায়।
১৫ মে পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর যে ৩১টি এলাকায় সংক্রমণ বেশি সেগুলো হলো মহাখালী (আক্রান্ত ২২৩ জন), যাত্রাবাড়ী (২২১), রাজারবাগ (২০৪), মুগদা (১৮৯), মোহাম্মদপুর (১৮৯), কাকরাইল (১৭৬), তেজগাঁও (১৩৮), লালবাগ (১১৭), বাবুবাজার (১১৫), উত্তরা (১০৪), মগবাজার (৯৮), ধানমন্ডি (৯৪), মালিবাগ (৯৩), বাড্ডা (৯০), বংশাল (৮২), খিলগাঁও (৮০), শাহবাগ (৭৩), গেন্ডারিয়া (৭৩), চকবাজার (৭০), শ্যামলী (৬৫), ওয়ারী (৬৪), গুলশান (৬৩), বাসাবো (৫৮), রামপুরা (৫৮), আগারগাঁও (৫৭), হাজারীবাগ (৫৭), রমনা (৫০), স্বামীবাগ (৪৯), মিরপুর-১ (৪৮), মিরপুর-১১ (৪৮) ও বনানী (৪৮ জন)।
সংক্রমণ বৃদ্ধির চিত্র
এখন পর্যন্ত রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে মহাখালীতে। রাজধানীর বড় দুটি বস্তি মহাখালী-গুলশান এলাকায়। মহাখালীর পাশে গুলশানেও সংক্রমণ বেশি দেখা গেছে। এক মাস আগে গত ১৫ এপ্রিল মহাখালী এলাকায় আক্রান্ত ছিলেন ১০ জন। গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬৪। দুই সপ্তাহ পর ১৫ মে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ২২৩ জনে। দুই সপ্তাহে এই এলাকায় আগের তুলনায় ৭১ শতাংশ সংক্রমণ বেড়েছে।
এক মাস আগেও যাত্রাবাড়ীতে আক্রান্ত ছিলেন ১৯ জন। এখন সেটা ২২১-এ পৌঁছেছে। সরকারি ছুটি ঘোষণার পর যাত্রাবাড়ী বাজার ছিল আলোচনায়। সেখানে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক লোকসমাগম দেখা গেছে। তবে এই কারণেই সংক্রমণ বেশি ছড়িয়েছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই এলাকায় শনাক্ত হন ৯১ জন। এর দুই সপ্তাহের মাথায় সেটা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। গত দুই সপ্তাহে এই এলাকায় সংক্রমণ বেড়েছে ৫৮ শতাংশ।
রাজারবাগ এলাকায় এক মাস আগে শনাক্ত হওয়া রোগী ছিলেন ৬ জন। এখন ২০৪ জন। তাঁদের বেশির ভাগই পুলিশ সদস্য। অবশ্য গত দুই সপ্তাহ সেখানে সংক্রমণ তুলনামূলক কম বেড়েছে। দুই সপ্তাহে বেড়েছে ৩২ শতাংশ। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এখানে আক্রান্ত ছিলেন ১৩৮ জন।
>সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে রাজধানী ঢাকায়। মোট আক্রান্তের ৫৭.৮৯ শতাংশই এখানে। সংক্রমণ ছড়িয়েছে নগরীর ১৮৩টি এলাকায়।
এক মাস আগে মুগদায় আক্রান্ত ছিলেন মাত্র একজন। সে সংখ্যা এখন ১৮৯। গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মুগদায় শনাক্ত হন ৬২ জন। গত দুই সপ্তাহে সেখানে রোগী বেড়েছে ১২৭ জন।
শুরু থেকে ঢাকার যেসব এলাকায় সংক্রমণ বাড়তে দেখা গিয়েছিল তার একটি মোহাম্মদপুর। মাঝখানে সেখানে সংক্রমণ সেভাবে বাড়েনি। গত দুই সপ্তাহে আবার বাড়তির দিকে। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত মোহাম্মদপুরে শনাক্ত হন ১০ জন রোগী। ৩০ এপ্রিল সেটা বেড়ে হয় ৬৮। গত দুই সপ্তাহে সেখানে ৬৪ শতাংশ আক্রান্ত বেড়েছে। এখন মোহাম্মদপুরে মোট আক্রান্ত ১৮৯ জন।
গত দুই সপ্তাহে সংক্রমণ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি আগারগাঁওয়ে। ৭৯ শতাংশ। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছিলেন ১২ জন। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৫৭।
৩১টি এলাকার মধ্যে কাকরাইল, শাহবাগ ও রাজারবাগে গত দুই সপ্তাহে সংক্রমণ বৃদ্ধির হার তুলনামূলক কম (২৩ থেকে ৩২ শতাংশ)। এই সময়ে অন্য এলাকায় ৩৪ থেকে ৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ৫০ জনের বেশি আক্রান্ত আছেন এমন এলাকাগুলোর মধ্যে রমনা, তেজগাঁও, বাবুবাজার, ধানমন্ডি, খিলগাঁও, শ্যামলী, রামপুরা এলাকায় গত দুই সপ্তাহে সংক্রমণ ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
এর বাইরে পুরো রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই সংক্রমণ বাড়ার দিকে। এর মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৫০-এর নিচে হলেও আদাবর, আজিমপুর, মানিকনগর, ইস্কাটন ও গ্রিন রোডে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে।
আইইডিসিআরের পরামর্শক ও রোগতত্ত্ববিধ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি, লকডাউনেও শৈথিল্য দেখা গেছে। বেশির ভাগ মানুষ, বিশেষ করে নিম্নবিত্তের মানুষের কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করার মতো আলাদা ঘর নেই। এসব কারণে রাজধানীতে সংক্রমণ বেশি। তিনি বলেন, এখনো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ আছে। এলাকা ভাগ করে স্বাস্থ্যকর্মী, প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়োগ করা দরকার। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি সেখানে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা নিশ্চিত করে কনটেইনমেন্ট জোন (অবরুদ্ধ অঞ্চল) করতে হবে। এই বিশ্লেষকের মতে, রাজধানীতে সংক্রমণ উচ্চপর্যায়ে গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে।