ঢাকায় বায়ুর মান সবচেয়ে বেশি খারাপ থাকে রাত একটার দিকে। মধ্যরাতে এখানকার বায়ুমানের সূচক থাকে গড়পড়তা (গ্যাসীয় ও কঠিন) ১৬২, যা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে বিবেচিত।
এদিকে গত জানুয়ারি মাসজুড়ে ঘুরেফিরে বিশ্বে শীর্ষ বায়ুদূষণের শহরের তালিকায় উঠে এসেছে ঢাকার নাম। গত মঙ্গলবারও রাত সোয়া ৯টায়ও শীর্ষে ছিল রাজধানী শহরটি। ওই সময় ঢাকার বায়ুমান সূচক ছিল ২৬০। বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল ৩ নম্বরে (সূচক ২০১)। যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্য থেকে এটি জানা গেছে।
স্ট্যামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পাঁচ বছরের (২০১৬-২০ সাল) তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান সূচক অনুসারে, শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত ‘ভালো’। ৫১ থেকে ১০০ ‘মোটামুটি’, ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত ‘সতর্কতামূলক’, ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’, ৩০১ থেকে ওপরে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ বা ‘দুর্যোগপূর্ণ’।
তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, দৈনিক গড় বায়ুমান সূচকে ঢাকায় দূষণ সবচেয়ে কম থাকে বিকেল ৪টার দিকে (সূচক ১২৫ বা ‘সতর্কতামূলক’); অর্থাৎ সর্বনিম্ন দূষণের সময়টাতেও বিশুদ্ধ বায়ু গ্রহণের সুযোগ নেই ঢাকাবাসীর।
উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকায় বিকেল চারটার পর দ্রুত বাড়তে থাকে দূষণ, যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে মধ্যরাতে। এরপর ধীরে ধীরে কমে ভোর ছয়টার দিকে হয় ১৫৪ বা অস্বাস্থ্যকর। দুই ঘণ্টা পর তা কিছুটা বেড়ে হয় ১৫৭। পরবর্তী সময়ে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দূষণ দ্রুত কমতে থাকে।
ক্যাপসের পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সবচেয়ে কম দূষণও এ দেশে অস্বাভাবিক দূষণ। শিশু, গর্ভবতী নারী, রোগী, বয়স্ক, শ্বাসকষ্টে ভোগা মানুষের জন্যও এটা ঝুঁকিপূর্ণ।
এই পরিবেশবিজ্ঞানী বলেন, বিকেল ৪টা থেকে অফিসগুলো ছুটি হলে রাস্তায় মানুষের চলাচল বেড়ে যায়, সঙ্গে বাড়তে থাকে বায়ুদূষণ। এ সময়ের দূষণ মূলত যানবাহনের। এ ছাড়া সন্ধ্যা ৬টার পর দূষণ বাড়তে থাকে আবহাওয়াগত (বায়ুপ্রবাহ, চাপ ও আর্দ্রতা) কারণে।
ক্যাপস পরিচালক বলেন, সূর্যাস্তের পর বায়ুপ্রবাহ কমতে থাকে; আর্দ্রতা বাড়ে। আর্দ্রতার কারণে ভাসমান ধুলাবালু বাতাসে আটকে থাকে। ফলে বায়ুদূষণ পরিমাপক যন্ত্রে দূষণ অনেক ধরা পড়ে।
রাত ১১টার দিকে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সড়ক ঝাড়ু দেওয়া শুরু করেন। এ কারণে সারা শহরে ধুলা উড়তে থাকে। এ ছাড়া রাত ১০টার দিকে ঢাকার ভেতর পণ্যবাহী ভারী ও ক্ষুদ্র যান চলাচল প্রবেশ করে, কিংবা ঢাকা হয়ে অন্য স্থানে যায়, জানান আহমদ কামরুজ্জামান।
পরিবেশবিদদের মতে, ঢাকার ভেতর নির্মাণসামগ্রী ঢেকে পরিবহন না করার কারণে ধুলা ছড়িয়ে পড়ে। আর রাতের ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি দ্রুতগতিতে চলায় জমে থাকা ধুলা চাকার সঙ্গে বাতাসে ছড়িয়ে যায়।
ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয় জানুয়ারি মাসে। গত পাঁচ বছরে এই মাসের গড়পড়তা বায়ুমান সূচক ছিল ২০৭ বা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’। এরপর ফেব্রুয়ারিতে। মাসটিতে গড় সূচক ছিল ২২৩ বা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’।
আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, নভেম্বর থেকে মার্চ শুষ্ক মৌসুম। সারা বছর যে বায়ুদূষণ হয়, তার ৭০ শতাংশের বেশি হয় এ পাঁচ মাসে। আর মে থেকে সেপ্টেম্বরে বায়ুদূষণ হয় ১৫ থেকে ২০ ভাগ। এপ্রিল ও অক্টোবরে বায়ুদূষণ হয় বাকিটা।
২০১৭ সালে বায়ুদূষণের ‘দুর্যোগপূর্ণ’ অবস্থা ছিল পাঁচ দিন; ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে ছিল চার দিন করে। আর গত বছর এ অবস্থা ছিল সাত দিন।
এই পাঁচ বছরে ঢাকার ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ দিন বেশি ছিল জানুয়ারিতে। গত বছরের জানুয়ারিতে বায়ুমান ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ ছিল ২৩ দিন। চলতি বছর জানুয়ারির প্রথম ২৫ দিনে তা ছিল ১৫ দিন।
পরিবেশবিজ্ঞানী আহমদ কামরুজ্জামানের মতে, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলে বায়ুদূষণ অনেকটাই কমে যাবে।
ঢাকার ১০টি এলাকায় কোন ঋতুতে ধুলা দূষণ কেমন, তা ১০ মাস ধরে পরীক্ষা করছে ক্যাপস। আবহাওয়াবিদদের কাছে ঋতু মূলত চারটি, প্রাক্-বর্ষা, বর্ষা, বর্ষা—পরবর্তী ও শীত (ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি)।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুসারে, এক বছরে বাতাসে দূষিত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত অনুমোদিত। সেই হিসাবে রাত একটার দিকে দূষণ স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণের বেশি হয়ে থাকে।
ক্যাপসের উপাত্তে দেখা যায়, গত ১০ মাসে সবচেয়ে বেশি ধুলা দূষণ হয়েছে শীতে। স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ধুলা দূষণ নিয়ে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকাটি।
ওই সময়ে সর্বনিম্ন দূষণ ছিল তেজগাঁও ও আহসান মঞ্জিল এলাকায়; সেটিও স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। এ ছাড়া প্রাক্-বর্ষা ঋতুতে সবচেয়ে দূষিত এলাকা ছিল শাহবাগ, স্বাভাবিকের চেয়ে সাত গুণ। বর্ষায় সবচেয়ে দূষিত ছিল মিরপুর ও গুলশান এলাকা; স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ। বর্ষা-পরবর্তী ঋতুতে সর্বোচ্চ ধুলা দূষণ ছিল তেজগাঁওয়ে; স্বাভাবিকের চেয়ে সাত গুণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের গত বছরের জুলাইয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মধ্যে রাস্তার ও মাটির ধুলা সবচেয়ে বেশি (প্রায় ৪৩ শতাংশ)। এরপর পরিবহনের ধোঁয়া সাড়ে ৩৬ শতাংশ।
পিএম ১০-এ ধুলার ভূমিকা ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ, গাড়ির ধোঁয়া প্রায় ৩৬ শতাংশ, জীবাশ্ম জ্বালানি ১৫ শতাংশ ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া সাড়ে ৬ শতাংশ।
এ গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাতাসে অনেক পদার্থই থাকার কথা না, কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের কারণে এই দূষিত পদার্থগুলো বাতাসে আসে।’ আবার ঢাকার গাড়ির কারণে ওড়া ধুলা ও কার্বন একত্রে মিশে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের নতুন ধরনের ক্ষতিকর উপাদান তৈরি হচ্ছে বলে জানান তিনি।