ঢাকার ছাদে পানিতে চাষ

ছাদবাগানে গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত শাহ আলম
ছবি: প্রথম আলো

ব্যবসায়ী শাহ আলমের রোজকার রুটিনটাই পাল্টে গেছে। সকাল-বিকেল ছাদে না গিয়ে থাকতে পারেন না। আর একবার ছাদে যাওয়া মানেই হলো মন ভালো হয়ে যাওয়া। তাঁর ১ হাজার ৮০০ বর্গফুটের ছাদে হাজারখানেক গাছ আছে।

শাহ আলম বললেন, ‘এক মাসের বেশি সময় ধরে সবজিবাগান করছি। এখন প্রতিদিনই লাউশাক, লেটুসপাতা, বাঁধাকপি, শসা, মরিচ, ফুলকপি, চাইনিজ ভেজিটেবল, মিষ্টিকুমড়া, ঝিঙেসহ বিভিন্ন শাকসবজি খাচ্ছি। টমেটোগাছ ফুলে ভরে গেছে।

বেগুনসহ অন্যান্য সবজির ফলন দেখে তো মনে হচ্ছে আমি বাণিজ্যিকভাবেই সবজি চাষ শুরু করে দিতে পারব।’

রাজধানীর মিরপুরে শাহ আলমের ছাদবাগানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি নতুন করে সব গাছ লাগিয়েছেন পানিতে। মাটি ছাড়া পানিতে সবজি চাষের আধুনিক এ পদ্ধতির নাম হাইড্রোপনিক। গাছের খাবার হিসেবে পানিতে নিউট্রিয়েন্ট ও অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা আছে।

সম্প্রতি শাহ আলমের নিজস্ব চারতলা ভবনের ছাদে গিয়ে দেখা গেল, চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। শাহ আলম শখ করে আগে থেকেই ছাদে গাছ লাগাতেন। ড্রাগন ফল, দারুচিনি, কমলাগাছসহ বিভিন্ন গাছ টবের মাটিতে লাগাতেন। আর এসবের সঙ্গে তিনি এবার নতুন কর্মযজ্ঞে নেমেছেন। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে বাগানের আকার বাড়াতে নতুন নতুন অবকাঠামো যোগ করছেন। এক পাশে নিজ উদ্যোগেই নতুন করে চারা উৎপাদনও করছেন।

বেসরকারিভাবে গ্রিন সেভারস নামের একটি সামাজিক উদ্যোগ জলচাষের মধ্যে আধুনিক হাইড্রোপনিক পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে। এ সামাজিক উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা আহসান রনির সার্বিক সহায়তায় শাহ আলম নতুন করে সবজি চাষাবাদ শুরু করেছেন।

ছাদবাগানে হাইড্রোপনিক পদ্ধতি সবজির চাষ করছেন শাহ আলম

প্রাথমিক পর্যায়ে ৪৪টি ড্রামসহ বিভিন্ন আকৃতির অবকাঠামো করতে এবং গাছ লাগানোর খরচ—সব মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকা লেগেছে। তবে খরচ সম্পর্কে শাহ আলম বলেন, এ পদ্ধতিতে চাষাবাদের বড় খরচ হয় প্রথম শুরু করার সময়। এরপর আর তেমন খরচ নেই। চারা লাগানো, পানিতে পরিমাণমতো পুষ্টি উপাদান নিউট্রিয়েন্ট মেশানো ছাড়া আর তেমন কোনো কাজও নেই। ১২ ফুট বাই ৮ ফুটের একটি অবকাঠামোতে ৫২৪টি গাছ লাগানো সম্ভব হয়েছে, যা মাটিতে লাগানো কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। প্রথমবারের পর থেকে চাষাবাদের প্রায় পুরোটাই লাভ থাকবে।

গাছের পরিচর্যা বলতে গেলে হাত বোলাতে বোলাতে শাহ আলম বললেন, মাটির তুলনায় পানিতে লাগানো গাছগুলো বেশি দ্রুত বড় হচ্ছে। এত টসটসে, দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। মাটিতে লাগানো গাছে সার, পরিচর্যা, কীটনাশক দিতে হয়। মাটিতে নিড়ানি, শ্রমিক, আগাছা পরিষ্কার, পোকামাকড় হওয়ার ঝামেলা থাকলেও পানিতে চাষ হলো ঝামেলামুক্ত চাষপদ্ধতি। পানিতে লাগানো শাকসবজির স্বাদেই বোঝা যায় এটা একদম প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া ফলন। আশপাশের অনেকেই শাহ আলমের মতো বাগান করার জন্য খোঁজখবর নিচ্ছেন। কথাটি বেশ গর্ব নিয়েই বললেন শাহ আলম।

আর শহুরে ছাদগুলো সবুজে সবুজে ভরে গেলে নগরবাসীর স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে।
ছাদে পানিতে চাষাবাদের আরও কিছু সুবিধার কথা উল্লেখ করে শাহ আলম বললেন, মাটিতে গাছ লাগালে বাড়তি ওজনে ছাদ ও ভবনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। প্রতিদিন গাছে বালতি বালতি পানি দিতে হয়। পানি বেশি বা কম দেওয়া হলো কি না, তা নিয়ে চিন্তা করতে হয়। পানিতে চাষাবাদে বলতে গেলে পানির তেমন খরচই নেই। পানি খুব কম লাগে। পানি কমল কি না, তা সাত দিনে একবার দেখলেই চলে।

শাহ আলমের ছাদ বাগান

শাহ আলম হাসতে হাসতে বললেন, ‘এখন সকাল-বিকেল ছাদে এসে বলতে পারেন, গাছের সঙ্গে দেখা করে যাই। প্রতিদিনই গাছ বড় হয়, আমার আনন্দও বাড়তে থাকে। সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয় এ গাছ দেখে।’

শাহ আলমের স্ত্রী সৈয়দা মোর্শেদা সুলতানার সময় কাটানোর জায়গাও এখন ছাদ। বললেন, ‘ছাদ থেকে টাটকা সবজি তোলার মজাই আলাদা। আগে বুয়েটে স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলে সবজি খেত না, এখন টাটকা সবজি দেখে না খেয়ে থাকতে পারে না।’

গ্রিন সেভারসের প্রতিষ্ঠাতা আহসান রনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে রাজধানীতে শাহ আলমদের মতো শহুরে চাষির সংখ্যা বাড়ছে। শহরে নিজেরা এক বছর পাইলটিং করার পর ২০১৯ সাল থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে ২০০-এর মতো বাসায় এ পদ্ধতিতে সবজি চাষে সহায়তা করেছেন। চাষের জন্য অবকাঠামো থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়াটিই তৈরি করে দেয় তাঁর প্রতিষ্ঠান। এরপরও কোনো সমস্যা হলে তারও সমাধান করে দেন তাঁরা।

শাহ আলমের ছাদ বাগান

আহসান রনির মতে, হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে কম জায়গা ও কম সময়ে অধিক ফলন ফলানো সম্ভব। এটি একটি সাশ্রয়ী ও টেকসই পদ্ধতি। যেকোনো মৌসুমেই ফসল ফলানো যায়। আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী এ পদ্ধতিতে ১৮, ৩২ বা ৭২টি গাছের জন্য প্লাস্টিকের অবকাঠামো পাওয়া যায়। তিন থেকে চার হাজার টাকা থেকে শুরু করে দুই লাখ টাকা অর্থাৎ যিনি যেভাবে চান, সেভাবেই বাগান তৈরি করে দেওয়া হয়।

নিউট্রিয়েন্ট বাবদ ৮০০ টাকায় প্রায় ৫ থেকে ৬ মাসের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়। পানি চলমান রাখার জন্য ৯ থেকে ১৮ ওয়াটের মোটর ব্যবহার করতে হয়। এ মোটর গাছের চাহিদা অনুযায়ী থেমে থেমে চলে, এতে মাসে বিদ্যুৎ বিল খুব বেশি লাগে না।