ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা জন্মাতে পারে এমন অসংখ্য স্থান, পাত্র ও বস্তু ঢাকা শহরজুড়েই আছে। তবে এমন স্থানও আছে, যেখানে সহজে এডিস মশার বাসস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঢাকা শহরের এমন ২১৪ একর এলাকায় ড্রোন উড়িয়ে তোলা ছবি পর্যালোচনা করে ৫ হাজার ৩৪৭টি এডিস মশার প্রজননস্থল পাওয়া গেছে।
নারিন্দা, মিরপুর ও কমলাপুর এলাকায় ড্রোন উড়িয়ে এডিস মশার সম্ভাব্য জন্মস্থান চিহ্নিত করেছে গ্রুপম্যাপারস ও ইগলেক্স নামের দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের এই জরিপ ফলাফল গত শুক্রবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।
গ্রুপম্যাপারস থাইল্যান্ডের হমিদোল বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিদোল-অক্সফোর্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন ইউনিটের একটি সহযোগী সংস্থা। তারা ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ম্যালেরিয়া রোগ ও তার ভৌগোলিক তথ্য বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সহায়তা দিয়ে আসছে। ইগলেক্স একটি নতুন উদ্যোগ। তারা ড্রোন ইমেজ ব্যবহার করে সমস্যা বিশ্লেষণে সহায়তা সেবা দেয়। ইগলেক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ‘ড্রোন প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা নিয়মিতভাবে মশা জরিপ করে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১০০টি নমুনা এলাকায় তারা বছরে তিনবার মশা জরিপ করে। এসব জরিপে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে মশার ঘনত্ব এবং পাত্রে (টায়ার, বালতি, মগ, কৌটা ইত্যাদি) জমে থাকা পানিতে লার্ভার উপস্থিতি দেখা হয়।
জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস মশাবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ব্যবস্থাপক এম এম আক্তারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মশা জরিপে সরাসরি মশার পরিমাণ জানা যায়। ড্রোনের মাধ্যমে মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল চিহ্নিত করা যাবে। ড্রোন জরিপের তথ্য ব্যবহার করে সিটি করপোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উদ্যোগী হলে এডিস মশাও কমবে, ডেঙ্গুও কমবে।
>নারিন্দা, মিরপুর ও কমলাপুর এলাকায় ড্রোন উড়িয়ে এডিস মশার ৫ হাজার ৩৪৭টি সম্ভাব্য জন্মস্থান শনাক্ত।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মোট আয়তন ৩১ হাজার ২৮৩ একর। এর মধ্যে ২১৪ একর বা দশমিক ৭ শতাংশ এলাকায় জরিপ করেছে গ্রুপম্যাপারস ও ইগলেক্স। তারা ড্রোন দিয়ে ৫ সেন্টিমিটার রেজল্যুশনের ইমেজ ব্যবহার করেছে। ১ আগস্ট একই দিনে তারা ড্রোন উড়িয়ে তিনটি এলাকার ছবি নিয়েছে। তারপর তা পর্যালোচনা করে মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল চিহ্নিত করেছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নারিন্দায় ১০৩০টি, মিরপুরে ২৭৫৮টি ও কমলাপুরে ১৫৫৯টি এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল আছে।
ড্রোনের মাধ্যমে এই তিনটি এলাকায় ১৮২টি খোলা পানির ট্যাংক ও ৪৫টি পানি সংরক্ষণাগার পাওয়া গেছে। টায়ার দেখা গেছে ৭৩২টি। ফুলের টব ২৪ হাজার ২১৬টি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র ১ হাজার ৯৮টি রয়েছে। পরিত্যক্ত পলিথিন ১ হাজার ৬১৪টি। এ ছাড়া বালতি, মগ, গ্লাসসহ নানা ধরনের পাত্র দেখা গেছে ২ হাজার ২৯৪টি।
মশা বিশেষজ্ঞরা বলেন, নির্মাণাধীন ভবন এডিস মশার প্রজননস্থল হিসেবে উপযুক্ত। ড্রোনের ছবিতে দেখা গেছে, নারিন্দার ১২৫ একর জায়গার মধ্যে নির্মাণাধীন ভবন ৪২টি। অন্যদিকে দুটি ভবন বা দুটি বাড়ির মধ্যে কী পরিস্থিতি, কোন ধরনের বর্জ্য কী পরিমাণে থাকে, তার ছবিও এই ড্রোনের মাধ্যমে এসেছে।
ড্রোনের মাধ্যমে এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করার কাজকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী। ভবনের ছাদে কী আছে, দুই বাড়ির মধ্যকার পরিস্থিতি কী, এটা সিটি করপোরেশন বা অন্য প্রশাসনের পক্ষে জানা-বোঝা মুশকিল। এই জরিপ থেকে এমন স্থানগুলোতে এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
এই জরিপের শুরুতে গ্রুপম্যাপারস ও ইগলেক্স স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তিন হাজার রোগী ও এডিস মশার ঘনত্ব সম্পর্কিত তথ্য নেয়। ওই তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে। নিজেদের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠান দুটি এই কাজ করেছে।
গ্রুপম্যাপারসের গবেষক ও মানচিত্র বিশেষজ্ঞ সাজিদ ইবনে জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের সক্ষমতা ও নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে সক্ষম হবে বলে আশা করি।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাদের কাজটি আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছে। আমরাও আমাদের অনেক কাজ ডিজিটাল পদ্ধতিতে করার চেষ্টা চালাচ্ছি। মশা নিয়ন্ত্রণে এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে তাদের প্রকল্প প্রস্তাব দিতে বলেছি। প্রস্তাব পাওয়ার পর আমরা সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখব।’