গৃহায়ণের মোহাম্মদপুর প্রকল্প
১৯৯৭ সালে প্লট দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি।
২০০৯ সালে প্লটের বদলে ফ্ল্যাটের সিদ্ধান্ত।
২০১৪ সালের মধ্যে সব ফ্ল্যাট হস্তান্তরের কথা ছিল।
ঢাকায় একটুকরো জমির জন্য জনতা ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চৌধুরী মমতাজ আফরোজী জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা জমা দিয়েছিলেন দুই দশকের বেশি সময় আগে। ইচ্ছা ছিল, জমিটি পেলে সেখানে নিজের একটি স্থায়ী ঠিকানা তৈরি করবেন।
এক যুগ পর জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ তাঁকে (মমতাজ আফরোজী) জানায়, প্লট নয়, দেওয়া হবে ফ্ল্যাট। আরও প্রায় এক দশক পরে ফ্ল্যাটের দামও বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়। কিন্তু প্রকল্প এখনো শেষ হয়নি।
মোহাম্মদপুরের এফ ব্লকের ওই প্রকল্পে ফ্ল্যাটের দাম বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু কাজ শেষ হয়নি।
মমতাজ আফরোজীর আর পরিবারসহ নিজের ফ্ল্যাটে ওঠা হয়নি। এর মধ্যে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। অসুস্থ বড় ছেলের চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এখন তাঁর পরিবার চলছে পেনশনের কিছু টাকা ও ছোট ছেলের সীমিত আয় দিয়ে। বাসাভাড়া দিতে হচ্ছে মাসে ১৮ হাজার টাকা। তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘মানুষের ধৈর্যের একটা সীমা আছে। আজ যদি অন্তত বাড়িভাড়া দেওয়া না লাগত, তাহলেও এত কষ্ট করে চলতে হতো না।’
মমতাজ আফরোজীর মতো অবস্থা প্রায় ৯০০ গ্রাহকের, যাঁরা গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ওই প্রকল্পের ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। প্রকল্পটি ঢাকার মোহাম্মদপুর হাউজিং এস্টেটের এফ ব্লকে। আদাবর থানার ঠিক উল্টো পাশে।
নথিপত্র ঘেঁটে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে তৎকালীন গৃহসংস্থান অধিদপ্তর (২০০১ সালে কর্তৃপক্ষ হয়) মোহাম্মদপুরের প্রায় সাত একর জমিতে আড়াই কাঠা, দুই কাঠা, পৌনে দুই কাঠা ও অসম আকৃতির মোট চার ধরনের প্লট বিক্রির জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দেয়। এর বিপরীতে প্রায় ২৩ হাজার আবেদন জমা পড়ে। প্লটের পরিবর্তে ফ্ল্যাট দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয় ২০০৯ সালে।
ভেতরে ভেতরে জমির বদলে ফ্ল্যাট দেওয়ার প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ২০০৬ সালে। কথা ছিল, ১৬ তলার ১৫টি ভবন হবে। তাতে মোট ৯০০ ফ্ল্যাট তৈরি করা হবে। আকার হবে দুই ধরনের—৮০০ (সব মিলিয়ে ১ হাজার ১৯০) ও এক হাজার বর্গফুট (সব মিলিয়ে ১ হাজার ৩৯০)।
শুরুতে ৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১৬ লাখ টাকার কিছু বেশি। ২০০৯ সালে আনুষ্ঠানিক বরাদ্দ শুরুর সময় একই আকৃতির ফ্ল্যাটের দাম ধরা হয় প্রায় ৩০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫২ লাখ টাকার কিছু বেশি। একইভাবে বাড়ানো হয়েছে এক হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দামও।
কথা ছিল, ২০১৪ সালের মধ্যেই সব কটি ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু হয়নি। পরে ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায় যে দ্রুত ১ থেকে ৫ নম্বর ভবনের কাজ শেষ হবে। তাই পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে গ্রাহকদের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী, মোট দামের প্রায় অর্ধেক চার কিস্তিতে জমা দিয়ে গ্রাহকেরা ফ্ল্যাট বুঝে পাবেন। বাকি টাকা দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে শোধ করবেন।
সম্প্রতি প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ছয়টি ভবনের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। ৯টি এখনো নির্মাণাধীন। অবশ্য গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের দাবি, ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। দুটি ছাড়া বাকি সব ভবনের কাজই শেষের দিকে। আগামী জুনের মধ্যেই পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
প্রকল্পের ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কর্তৃপক্ষের তাগিদে বেশির ভাগ গ্রাহক বকেয়া কিস্তি পরিশোধ করার পরও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়নি।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ঢাকা বিভাগ-২–এর নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমানের সই করা এক চিঠিতে গত বছর জুলাই মাসে গ্রাহকদের বলা হয়, ‘৩১ জুলাইয়ের মধ্যে বাস্তব দখল বুঝে নিতে ব্যর্থ হলে ধরে নেওয়া হবে উক্ত তারিখেই গ্রাহকের নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটটির দখল হস্তান্তরিত হয়েছে এবং প্রসপেক্টাস (বিবরণপত্র) অনুযায়ী পরবর্তী কিস্তি পরিশোধের তারিখ নির্ধারিত হবে।’ এমন পরিস্থিতিতে গত বছর ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানোর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের একাংশ উচ্চ আদালতে রিট করেন। রিটকারীরা জানিয়েছেন, আদালত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগেই অবশ্য ১৫টির মতো পরিবার গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নতুন নির্ধারিত মূল্য মেনে নিয়েছে। পাশাপাশি মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে মামলা করতে না পারার শর্ত মেনে নিয়ে নিজ নিজ ফ্ল্যাটে উঠে গেছে।
বিপাকে পড়েছেন সীমিত আয়ের মানুষেরা। রেবেকা আক্তার নামের এক গ্রাহক আক্ষেপ করে বলেন, ‘খেয়ে না–খেয়ে প্রথম চার কিস্তির টাকা পরিশোধের পর জানতে পারলাম, দাম প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে।’
রিট আবেদনকারী গ্রাহকেরা মামলা নিষ্পত্তির আগেই ফ্ল্যাটে ওঠার সুযোগ চান। এ বিষয়ে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. দেলওয়ার হায়দার বলেন, এ জন্য গ্রাহকেরা একটা আবেদন করতে পারেন। আইনগত সুযোগ থাকলে পরিচালনা পর্ষদ বিষয়টি বিবেচনা করবে।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের প্রকল্পটির পরিচালক বদলেছেন মোট ১৩ বার। এখনকার পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, জমিতে অবৈধ দখল, আশপাশের লোকজনের বাধা ও ঠিকাদার ঠিকমতো কাজ না করায় সময় বেশি লেগেছে।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সময়মতো ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে না পারায় ভুক্তভোগী গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, এত দিনে কাজ শেষ না হওয়া এবং গ্রাহকদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেওয়া সরকারের নিজের তৈরি রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইনের লঙ্ঘন। এ আইন অনুযায়ী জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিকভাবে ফ্ল্যাটের দাম বাড়াতে পারে না, এভাবে সময় ক্ষেপণ করতে পারে না। সময় ক্ষেপণ করলে প্রতিবছরের জন্য গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।