করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তে নেমে জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান চিকিৎসক সাবরিনা আরিফের জাতীয় পরিচয়পত্র ও আয়কর বিবরণী সনদ তৈরিতেও জালিয়াতির তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। প্রায় এক বছর তদন্তের পর তার প্রমাণ পেয়ে এখন অভিযোগপত্র দিতে যাচ্ছে তারা।
ঢাকার বাড্ডা থানায় করা জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির ঘটনায় করা মামলার তদন্তের তদারক করছেন ঢাকা মহানগর ডিবির উপকমিশনার মশিউর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে হওয়া জালিয়াতির মামলার তদন্ত শেষ। তাঁর বিরুদ্ধে জালিয়াতি করার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন মামলার অভিযোগপত্র প্রস্তুতে কাজ চলছে।’
মহামারির মধ্যে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা না করে ভুয়া সনদ দেওয়ার অভিযোগে করা একটি মামলায় গত বছরের ১২ জুলাই সাবরিনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ছিলেন তিনি। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। তার আগে গ্রেপ্তার হন তাঁর স্বামী আরিফুল চৌধুরী। তিনি ছিলেন জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ দেওয়ার মামলায় গত বছরের ৫ আগস্ট সাবরিনা, আরিফসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ। ওই মামলার বিচারও শুরু হয়েছে। এই দম্পতি এখন রয়েছেন কারাগারে।
জালিয়াতি করে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির অভিযোগে গত বছরের ৩০ আগস্ট সাবরিনার বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় আরেকটি মামলা হয়। ওই মামলার তদন্ত করছে ডিবি।
উপকমিশনার মশিউর বলেন, সাবরিনা প্রকৃত জন্মতারিখ ও স্থায়ী ঠিকানা গোপন করে যে দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্র ও আয়কর বিবরণী সনদ বানিয়েছিলেন, তা প্রমাণিত হয়েছে।
এই জালিয়াতিতে নির্বাচন কমিশন ও আয়কর বিভাগের ‘কিছু কর্মচারীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে’ জানিয়ে মশিউর রহমান বলেন, ‘সাবরিনার সঙ্গে তাদের অভিযোগপত্রভুক্ত করা হবে কি না, সে বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাবরিনা ২০০৯ সালে প্রথম জাতীয় পরিচয়পত্র করেন। এতে তাঁর নাম লেখা রয়েছে- সাবরিনা শারমিন হোসেন, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা-১২২/ক; পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটি মোহাম্মদপুর; জন্মতারিখ-২ ডিসেম্বর, ১৯৭৮ সাল; পেশা-সরকারি চাকরি। বাবার নাম সৈয়দ মুশাররফ হোসেন ও মায়ের নাম কিশোয়ার জেসমিন।
এরপর ২০১৬ সালে তাঁর আরেকটি জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য পায় ডিবি। তাতে নাম-সাবরিনা শারমিন হুসেন, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা-১৪/এ আনোয়ার ল্যান্ড মার্ক, বাড্ডা; জন্মতারিখ ২ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল। এতে বাবার নাম সৈয়দ মুশাররফ হোসেন, মায়ের নাম জেসমিন হুসেন রয়েছ; পেশা উল্লেখ করা হয়েছে চিকিৎসক।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, সাবরিনা ১৯৯১ সালে এসএসসি ও ২০০০ সালে এমবিবিএস পাস করেন। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে করা দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী সাবরিনা ১৭ বছরে এমবিবিএস ও ৮ বছর বয়সে এসএসসি (মাধ্যমিক) পাস করেছেন। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে করা দ্বিতীয় আয়কর বিবরণী সনদে একই ধরনের তথ্য রয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রিপন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে করা সাবরিনার দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্রে বায়োমেট্রিক ছিল না। দ্বিতীয় জালিয়াতি করা জাতীয় পরিচয়পত্র ও আয়কর বিবরণী সনদের তথ্য প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বত্রই এ তথ্য দিচ্ছিলেন তিনি। এ ছাড়া একই কারণে সাবরিনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নথি থেকে তাঁর এসএসসি পাশের সার্টিফিকেট সরিয়ে ফেলেছেন। সে কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাবরিনার এসএসসি পাশের সার্টিফিকেট ডিবিকে দিতে পারেনি।’
পুলিশ কর্মকর্তা রিপন মনে করেন, সরকারি চাকরিতে বেশি সময় থাকার উদ্দেশ্যে সাবরিনা এই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।
সাবরিনাকে গ্রেপ্তারের পর হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল ডিবি। এসআই রিপন বলেন, ‘রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদকালে তিনি দাবি করেন, ২৭তম বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস (স্বাস্থ্য) উত্তীর্ণ হন তিনি। যদিও তিনি ২৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। রিমান্ডে তিনি ডিবি কর্মকর্তাদের শুধুই বিভ্রান্তিতে ফেলেছেন।’