৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টিতে ৭৫ শতাংশের বেশি দরিদ্র পরিবারের মাসিক গড় আয় সাড়ে ৮ হাজার টাকার কম।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মধ্যে গরিব মানুষ সবচেয়ে বেশি থাকে পশ্চিম জুরাইন এলাকায়। আর জুরাইন থেকে সাড়ে ছয় কিলোমিটার দূরে মতিঝিলে গরিব মানুষের বসতি নেই। ওয়ার্ডের হিসাবে জুরাইন পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে, আর মতিঝিলের অবস্থান ১০ নম্বর ওয়ার্ডে। জুরাইন ওয়ার্ডের এক–চতুর্থাংশ এলাকায় দরিদ্র মানুষের বসবাস। নাগরিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও এখানকার মানুষ পিছিয়ে।
মতিঝিল মূলত বাণিজ্যিক এলাকা। বসতি বলতে সেখানে সরকারি কলোনি ও কোয়ার্টার রয়েছে। তবে বিছিন্নভাবে ফুটপাতে কিছু ছিন্নমূল মানুষ থাকে।
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে করা এক গবেষণায় এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এই গবেষণার উদ্দেশ্য হচ্ছে নগরে দারিদ্র্য কমানোর উপায় খোঁজা।
থাকার জায়গা, সুপেয় পানি, গোসলের পানির সার্বক্ষণিক সুবিধা, শৌচাগারের ব্যবস্থা, জমি ভোগ–দখলের নিরাপত্তা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ–সংযোগ, সড়ক ও ড্রেনের (নালা) সুবিধাসহ ১৬ ধরনের নাগরিক সুবিধাকে বিবেচনায় নিয়ে গত বছরের অক্টোবরে দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডের ওপর এই গবেষণা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে কাজটি করেছে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট (ডিএম) ওয়াচ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
গবেষণায় বলা হয়, দক্ষিণ সিটির মোট ১০টি ওয়ার্ডে (১, ৭, ১৫, ১৬, ৩২, ৩৩, ৪০, ৫০, ৫৫ ও ৭৫) দরিদ্র মানুষের বসবাসের এলাকায় যথাযথ পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। এসব ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতাও বেশি হয়। দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টিতে ৭৫ শতাংশের বেশি দরিদ্র পরিবারের মাসিক গড় আয় সাড়ে ৮ হাজার টাকার কম।
জুরাইনের নাগরিক সেবা সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তায় ধুলা ওড়ে। বৃষ্টি হলে বাসাবাড়িতে পানি ঢোকে। কিছু এলাকায় এখনো ওয়াসার পানিতে ময়লা আসে। যাতায়াতের ক্ষেত্রে পরিবহন সমস্যা রয়েছে। নাগরিক সেবার মান খারাপ হওয়ায় বাসাভাড়া তুলনামূলক কম। যে কারণে গরিব মানুষ বেশি থাকে।
একটি ওয়ার্ডের কোথায় অনুন্নত বা দরিদ্র জনগোষ্ঠী বসবাস করে, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করলে পরবর্তী সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ঠিকভাবে করা যাবে না।এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী , ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
গবেষণার তথ্যানুযায়ী, গরিব মানুষ জুরাইনে বেশি থাকলেও তাঁদের ঘনত্ব বেশি ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের এলাকার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বংশাল রোড, আব্দুল হাদী লেন, নবাব কাটরা, আগামসিহ লেন, সিক্কাটুলী লেন ও আগা সাদেক রোড।
এই গবেষণার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী প্রথম আলোকে বলেন, একটি ওয়ার্ডের কোথায় অনুন্নত বা দরিদ্র জনগোষ্ঠী বসবাস করে, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করলে পরবর্তী সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ঠিকভাবে করা যাবে না। এই গবেষণা করে দারিদ্র্য নিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার।
গত মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মিলনায়তনে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে দরিদ্র বসতি মানচিত্রায়ণ, শহর পর্যায়ে ফলাফল উপস্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু ওই দিন অনুষ্ঠান শুরুর আধঘণ্টার মাথায় গবেষণার ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কাউন্সিলরা। একপর্যায়ে তাঁরা হইচই করলে অনুষ্ঠানটি পণ্ড হয়ে যায়। অনুষ্ঠানে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসও উপস্থিত ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেও এই গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গবেষণা দলের প্রধান বায়েজীদ হাসান। তিনি পরে প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণার কোন বিষয়ে আপত্তি, সেটি কাউন্সিলররা সেদিন বলেননি। অথচ গবেষণার সময় প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের মনোনীত প্রতিনিধিরাও মাঠপর্যায়ের কাজে যুক্ত ছিলেন। পুরো ওয়ার্ডের সামগ্রিক চিত্র নয়, বরং দরিদ্র মানুষের জীবনমান ও সেবা পাওয়ার ধরন নিয়ে কাজটি হয়েছে।
গবেষণার তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণ সিটিতে জুরাইনের পর বেশি গরিব মানুষ থাকে নতুন যুক্ত হওয়া ৫৮ ও ৭১ নম্বর ওয়ার্ডে। কদমতলী, নতুন শ্যামপুরসহ কয়েকটি এলাকা নিয়ে ৫৮ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি এলাকায় দরিদ্র মানুষের বাস। ৭১ নম্বর ওয়ার্ডটি আগে ইউনিয়ন (মান্ডা) ছিল। এই ওয়ার্ডেও মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি এলাকায় দরিদ্র মানুষেরা বাস করে।
গবেষণালব্ধ ফলাফল নগরের দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজে লাগানো উচিত বলে মনে করেন নগর–পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, মেয়র ও কাউন্সিলরদের সততা ও সদিচ্ছা থাকলে গরিব মানুষের উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের প্রকল্প যেন লোক দেখানো না হয়। গরিবের উন্নয়নে বড় প্রকল্প নিয়ে সেখান থেকে কমিশন–বাণিজ্য করলে সেই প্রকল্পের কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।