বিদেশে লেখাপড়া করে আসা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের হাত ধরে দেশ ঢুকছে নতুন নতুন সব ভয়াবহ মাদক। তার সর্বশেষ সংস্করণ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে পড়েছে ‘ম্যাজিক মাশরুম’ নামের একটি মাদক। ‘হ্যালুসিনেশনের’ মাধ্যমে সাময়িক সময়ের জন্য কল্পরাজ্যে নিয়ে যাওয়া এই মাদক পরিণামে জীবন ধ্বংস করে দেয়।
কয়েক মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের ‘আত্মহত্যা’র কারণ অনুসন্ধানে নেমে নতুন নতুন শক্তিশালী মাদকের সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের অভিযানে এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড), ডিএমটি (এনএন ডাইমিথাইলট্রিপটামিন), ব্রাউনি বা গাঁজার কেক (টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল), ক্রিস্টাল মেথ বা আইস (মিথাইল এম্পেফিটামিন) এবং খাট (ক্যাথিনোন ও ক্যাথিন) নামের মাদক ধরা পড়ে।
দেখা গেছে, এসব মাদকের বেশির ভাগই দেশে এসেছে বিদেশফেরত শিক্ষার্থীদের হাত ধরে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৫০ ধরনের ম্যাজিক মাশরুম রয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই পাওয়া যায় ইউরোপ ও আমেরিকায়। এসব দেশে পড়াশোনা করতে যাওয়া ধনীদের সন্তানদের একটি অংশ মাদকে আসক্ত হয়। তাদের বেশির ভাগেরই ভয়ংকরভাবে শক্তিশালী মাদকে আসক্তি থাকে।
নতুন নতুন মাদক ধরা পড়ার ধারাবাহিকতায় ‘ম্যাজিক মাশরুম’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে আসে। এ মাশরুম মাদকটি সাধারণ মাশরুম থেকে একেবারে আলাদা। এই মাশরুম ভাঙার পর বিভিন্ন রং ধারণ করে। কখনো লাল, কখনো নীলসহ নানা রং হয়, যা সাধারণ মাশরুমে হয় না।
শারীরবৃত্তীয় প্রভাবের ওপর নির্ভর করে মাদকের চারটি ভাগের মধ্যে ম্যাজিক মাশরুম হলো সাইকেলেডিক (হ্যালুসিনোজেন) ড্রাগের অন্তর্ভুক্ত। এটা মস্তিষ্কের ‘নিউরাল হাইওয়ের’ ওপর প্রভাব তৈরি করে। আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায়, ম্যাজিক মাশরুম মস্তিষ্কের সম্মুখভাগের বহিরাবরণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। মস্তিষ্কের এই অংশটি অবাস্তব চিন্তা ও বিষণ্নতা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মেজাজ ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় ‘ম্যাজিক মাশরুম’ স্বল্প মাত্রায় ব্যবহারে সুফল পাওয়া যায় বলে গবেষণায় দেখা গেছে। তবে দীর্ঘদিন এটা ব্যবহার করলে ‘সাইকেডেলিক’ প্রভাব দেখা দেয়, যার ফলে নানা ধরনের অস্বাভাবিক সমস্যা তৈরি হয়। দীর্ঘদিন এই মাদক ব্যবহারের ফলে মানসিক রোগ, যেমন সাইকোসিস ছাড়াও অবিরাম হ্যালুসিনেশন হয়।
তা ছাড়া ম্যাজিক মাশরুম শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণে দেহে হরমোন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যাওয়া বা হরমোন নিঃসরণের ধরন বদলে যেতে পারে, যা দেহের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এই মাদক দীর্ঘদিন সেবনে স্নায়ুতন্ত্রের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে। স্নায়ুতন্ত্র সঠিকভাবে কাজ না করায় ঘুমের সমস্যা, ক্ষুধামান্দ্য, স্মৃতিভ্রম, পায়খানা-প্রস্রাব ঠিকমতো না হওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রতিবার এই মাদক সেবনের প্রতিক্রিয়া ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। এ সময় সেবনকারীর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন তিনি যেকোনো ধরনের অঘটন ঘটাতে পারেন।
যে ছাত্র, তরুণ ও যুবসমাজ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, একসময় জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল হিসেবে যারা বিবেচিত হয়েছে, আজ তারা মাদকের ভয়াল থাবায় বিপথগামী। সন্ত্রাসবাদ ও কূপমণ্ডূকতার প্রতিভূ জঙ্গিবাদের সঙ্গে দৃশ্যত এদের জড়িয়ে পড়ার পেছনে মাদকের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। তবে সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে মাদকাসক্তি রোধ ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সবাইকে যত্নবান হতে হবে। দেশের প্রাণশক্তি তরুণ ও যুবসমাজকে সব ধরনের সর্বনাশা মাদকের থাবা থেকে মুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক