তেষ্টা পেলে অনেকেই ধারেকাছের দোকানে গিয়ে চটপট গলাটা ভিজিয়ে নেন। এক টাকায় জার থেকে পাওয়া যায় পরিষ্কার এক গ্লাস পানি। তেষ্টা মিটল, প্রাণ জুড়াল—ভালো কথা। কিন্তু যে জারের পানিতে অগাধ বিশ্বাস, তা ঠিক আছে তো? শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য তা ভালো তো?
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মুরগির দোকানগুলোর পাশেই হাসান মিয়ার দোকান। চা-বিস্কুট-পাউরুটিসহ নানা খাবার রয়েছে সেখানে। ক্রেতাদের জন্য পানির জারও আছে। প্রতি গ্লাস পানি এক টাকা। জারের গায়ে সাদা রঙে ‘ফারুক’ লেখা থাকলেও নেই পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের কোনো সিল।
পানিভর্তি জারের দাম ৩০ টাকা। এতে থাকে ১৯ লিটার পানি। হাসান মিয়া বলেন, ‘পানি বিক্রি কইর্যা ভালো লাভ।’
পানি কোত্থেকে আসে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, তেজগাঁওয়ের জনৈক ‘রায়হান ভাইয়ের’ বাসা থেকে। এ দোকানে যে পানি বিক্রি হচ্ছে, এতে বিএসটিআইয়ের সিল-ছাপর নেই কেন—এমন প্রশ্নে হাসানের মুখের অভিব্যক্তি দেখেই বোঝা যায়, এই সিল বা সরকারি অনুমোদন নিয়ে কোনো ধারণা নেই তাঁর। দোকানে পানি খাচ্ছিলেন রিকশাচালক শেখ রহমান। পানি ভালো কী মন্দ—এ বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁরও। বললেন, ‘বড় বোতলের (জার) মইদ্দে আছে। ভালোই হইব।’
হাসান মিয়ার কাছ থেকে পানি উৎপাদনকারী রায়হানের মুঠোফোন নম্বর নিয়ে তাঁকে ফোন করেন এই প্রতিবেদক। পানি উৎপাদনে অনুমোদনের বিষয়ে কথা বলতেই তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর বন্ধ পাওয়া যায় ফোন।
রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় এখন যত্রতত্র জারের পানি উৎপাদনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। চলছে অবৈধ বিক্রি। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) কোনো অনুমোদন ছাড়াই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) এস এম ইসাহাক আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘জারের পানির নিবন্ধনহীন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আবার যাদের নিবন্ধন আছে, তাদের অনেকেই পানির মান বজায় রাখে না। দেখা যাচ্ছে, নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানও একই জার একাধিকবার ব্যবহার করে। এতে দূষিত পানি বিক্রি চলছে দেদার।’
ইসাহাক আলী বলেন, ‘এখন জার বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে আমাদের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। সর্বোচ্চ নয় লিটারের বেশি পানির বোতল আর বিক্রি করতে দেওয়া হবে না—এমন ভাবনা আছে।’
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা জারের পানি নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) গবেষণা করে। সেখানে দেখা যায়, ঢাকার বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে সরবরাহ করা শতকরা ৯৭ ভাগ জারের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় মানুষ ও প্রাণীর মলের জীবাণু ‘কলিফর্ম’ আছে। সংগ্রহ করা নমুনাগুলোয় মোট কলিফর্মের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মাত্রা পাওয়া গেছে যথাক্রমে ১৭ ও ১৬০০ এমপিএন (মোস্ট প্রবাবল নম্বর) এবং ফিকাল কলিফর্মের (মলের জীবাণু) ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল যথাক্রমে ১১ ও ২৪০ এমপিএন।
পানির এই গবেষণার ফল প্রকাশের পর থেকে র্যাব ও বিএসটিআই অভিযান শুরু করে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পরিচালিত সাতটি অভিযানে অনিবন্ধিত ৪৪টিসহ ৪৮টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ধ্বংস করা হয় প্রায় ২০ হাজার জার। কারাদণ্ড দেওয়া হয় ৩৩ জনকে।
বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক (সিএম) মো. রিয়াজুল হক বলেন, ‘আমাদের ধারণা, এখন পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অবৈধ জারের প্রতিষ্ঠান আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। এর বাইরে অনেক আছে। আসলে এই ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে।’
পরিশোধন তো দূরে থাকুক, স্রেফ সরবরাহের পানি সরাসরি জারে ভরে এখন বিক্রির ঘটনা ঘটছে। আর এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, এলাকায় তাঁরা ব্যাপক প্রভাবশালী।
গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর ভাটারায় বিএসটিআই অভিযানে গিয়ে দেখতে পায়, বাসাবাড়ির ওয়াসার লাইন থেকে পানি সরাসরি জারে ভরা হচ্ছে। যেসব জারে পানি ভরা হচ্ছে, সেগুলো পুরোনো, ময়লাযুক্ত। অভিযানে দোষী ব্যক্তিকে ধরা হলে এলাকার লোকজন জড়ো হয়। পড়ে অনেক কষ্টে তাকে বের করে নিয়ে আসা হয় এবং কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) এস এম ইসাহাক আলী বলেন, ‘স্থানীয় প্রভাবশালীরা পানির ব্যবসায় নেমেছে। তারা যথেচ্ছভাবে পানির ব্যবসা করছে।’
যেভাবে বিএসটিআইয়ের নিবন্ধন নিতে হয়
জারের বা বোতলজাত পানির মান নিয়ন্ত্রণ ও নিবন্ধন করে বিএসটিআই। যেসব প্রতিষ্ঠান পানি উৎপাদন করবে, তাদের বিএসটিআই বরাবর দরখাস্ত দিতে হয়। দরখাস্তের সঙ্গে ট্রেড লাইসেন্স, পানির নমুনা, ভ্যাটের কপিসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র দিতে হয়। এরপর একটি দল পরিদর্শনে যায়। তাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নতুন একটি দল আবার পরিদর্শন করে কারখানাটি। বিএসটিআই পানিতে রাসায়নিক, অনুজৈবিক ও ভারী ধাতব উপাদান পরীক্ষা করে। এরপর যে প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত হয়, একটি প্যানেল তাদের অনুমোদন দেয়। সেখানে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের একজন প্রতিনিধি, বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক, একজন বিশেষজ্ঞ, বিএসটিআইয়ের পরিচালক (মান) থাকেন। এই প্যানেলই নিবন্ধন দেয়। এসব নিবন্ধন আবার নির্দিষ্ট মেয়াদে নবায়ন করতে হয়।
নামহীন প্রতিষ্ঠানের জার বিক্রি হচ্ছে বেশি
বিএসটিআইয়ের তালিকা অনুযায়ী, ৩১৫টি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান জারের পানি উৎপাদন করে। এর মধ্যে ১৬৬টিরই নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান এখন আদৌ পানি উৎপাদন করছে কি না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয় বিএসটিআই। একই জার কতবার ব্যবহার হয়, তাও ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিবন্ধিত কোম্পানির জার কেনে ঠিকই, কিন্তু এর সঙ্গে অনিবন্ধিত, নামহীন প্রতিষ্ঠানের জার বিক্রি করে অনেক বেশি পরিমাণে। রাজধানীর মতিঝিলে গত ফেব্রুয়ারিতে র্যাব-বিএসটিআইয়ের অভিযানে দেখা যায়, নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের ৩০টির মতো জার আছে। কিন্তু প্রায় ২০০ জার ছিল অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের।
সাতটি অভিযানের মধ্যে ছয়টিতেই ছিলেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এসব জারের পানি ব্যবসায়ীরা তিন ধরনের অপরাধ করছে। প্রথমত, এরা পানি কোনোরূপ শোধন না করেই জারে ভরে। দ্বিতীয়ত, এসব জার একেবারে খাবার পানি রাখার মতো না। তৃতীয়ত, এগুলোতে এমন ময়লা জমে থাকে যে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ অবশ্যম্ভাবী। একের পর এক গজিয়ে ওঠা জার কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিতে চায় বিএসটিআই।
পরিচালক এস এম ইসাহাক আলী জানান, এখন প্রতিটি পানির বোতলে ও জারে ‘ড্রিংকিং ওয়াটার’ বা খাবার পানি লেখা থাকে। বিএসটিআইয়ের পরিকল্পনা হলো, প্রতিটি বোতলে ‘বটলড ওয়াটার’ বোতলজাত পানি লেখা হবে। সর্বনিম্ন ২০০ মিলিলিটার থেকে সর্বোচ্চ নয় লিটারের পানি লেখা থাকবে।