গুলিস্তান কমপ্লেক্স

জমি ট্রাস্টের, লাভবান অন্যরা

২০০ কোটি টাকা দামের জমি দিয়ে একটি দোকানের মালিকানাও পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট।

রাজধানীর গুলিস্তান মোড়ে প্রায় দুই বিঘা জমির মালিক বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। আবাসন ব্যবসায়ীদের হিসাবে জমিটির বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকার বেশি। দুই দশক আগে এ জমিতে নেওয়া গুলিস্তান কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পে ‘সবাই’ লাভবান হয়েছেন, শুধু ট্রাস্ট ছাড়া।

গুলিস্তান কমপ্লেক্সের ডেভেলপার বা উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠান দ্য মেসার্স ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স ৬৯০টি দোকান বিক্রি করে চলে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির দুই পরিচালকের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে দোকান বিক্রির অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ট্রাস্টের নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। অবশ্য ট্রাস্ট বৈধভাবে একটি দোকানও পায়নি। এখন নিজের জমিতে তৈরি ভবনের একটি তলার একাংশ ‘দখল’ করে কার্যালয় করতে হয়েছে তাদের।

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে গঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে যেসব সম্পদ দেওয়া হয়, তার একটি ছিল গুলিস্তানের এই জমি (প্রায় ৬৩ শতাংশ)। এতে একসময় সিনেমা হল ও রেস্তোরাঁসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এসব প্রতিষ্ঠান লোকসানে যাওয়ার পর ১৯৯৯ সালে বহুতল কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ট্রাস্ট। ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০০১ সালে।

কথা ছিল, ২০ তলা ভবন নির্মাণের পর ট্রাস্ট দুটি তলার মালিকানা পাবে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টাকা বা সালামি নিয়ে দোকান বরাদ্দ দেবে। পরে সেই দোকানের ভাড়া পাবে ট্রাস্ট। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, চুক্তির পর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রথম ৯ বছরে গুলিস্তান কমপ্লেক্সের ১১ তলা পর্যন্ত কাজ করে চলে যায়। এরপর থেকে সেই অবস্থায় পড়ে আছে কমপ্লেক্সটি।

সাধারণত এ ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে জমির মালিক বড় অঙ্কের অর্থ ‘সাইনিং মানি’ হিসেবে পান। ট্রাস্ট এ ক্ষেত্রে কোনো টাকা পায়নি। ভবন নির্মাণ সমাপ্ত না হওয়ায় চুক্তি অনুযায়ী দুটি তলার মালিকানাও পায়নি সংস্থাটি। ট্রাস্টের বর্তমান প্রশাসনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, গুলিস্তানের মতো জায়গায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অন্তত ৫০ কোটি টাকা সাইনিং মানি ও ভবনের অর্ধেক মালিকানা পেতে পারত ট্রাস্ট। চুক্তিটি এমনভাবে করা হয়েছিল, যেখানে ট্রাস্টের তেমন কোনো লাভ হয়নি।

সামান্য ভাড়া পায় ট্রাস্ট

সম্প্রতি গুলিস্তান কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির পুরো কাজ শেষ হয়েছে ৯ তলা পর্যন্ত। দশম তলার কাজ হয়েছে আংশিক। ১১তম তলায় শুধু ছাদ ঢালাই করা হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন তলায় পোশাক, জুতা, ব্যাগ, ইলেকট্রনিকসসহ নানা পণ্যের দোকান। আবার কয়েকটি তলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়।

ট্রাস্টের তথ্য অনুযায়ী, গুলিস্তান কমপ্লেক্সে এখন থাকা ১ হাজার ৭৪টি দোকানের ৬৯০টি বরাদ্দ দিয়ে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স নিয়েছে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা। তারা এর বাইরে আরও ১৪০টি দোকানের সালামি বাবদ ১৬ কোটি টাকা নিলেও বরাদ্দপত্র দিয়ে যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির দুই পরিচালক ১৫৮টি দোকানের বিপরীতে প্রায় ১৫ কোটি টাকা নিয়েছেন। ৮৬টি দোকান সালামি ছাড়াই পুরোনো ভাড়াটেদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

ট্রাস্টের হিসাব অনুযায়ী, গুলিস্তান কমপ্লেক্সে প্রতি বর্গফুটে তলাভেদে প্রায় ৬ থেকে সাড়ে ১১ টাকা ভাড়া পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে মাসে ভাড়াবাবদ ট্রাস্টের আয় সাড়ে ১২ লাখ টাকার মতো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গুলিস্তান এলাকায় বেসরকারি বিভিন্ন বিপণিবিতানে ভাড়া দোকানের অবস্থানভেদে বর্গফুটপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা।

একে অপরকে দোষারোপ

ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সের সঙ্গে চুক্তিতে ছয় বছরের মধ্যে গুলিস্তান কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান একে অপরকে দোষারোপ করছে।

নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বলছে, ট্রাস্ট সময়মতো জমি বুঝিয়ে দিতে না পারায় তাদের কাজ শুরু করতেই ৩ বছর ৯ মাসের মতো দেরি হয়। ২০১০ সালে ট্রাস্ট নিরাপত্তাকর্মীদের সরিয়ে নেয়। ফলে তারা কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সের পরিচালক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিকভাবে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

অবশ্য ট্রাস্টের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্মাতা দোকান বরাদ্দের টাকা নেওয়ার পর কাজ বন্ধ করে চলে গেছে।

দায় নেয়নি কেউ

ট্রাস্টের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গুলিস্তান কমপ্লেক্স নির্মাণের মূল উদ্যোক্তা এখন প্রয়াত। তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক দীর্ঘদিন আগে অবসরে গেছেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই কমপ্লেক্স দেখভালের দায়িত্ব পান (প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে) আবদুল কাইয়ুম খান নামে ট্রাস্টের এক কর্মকর্তা। তিনি দাবি করেন, ভবনের বরাদ্দসহ বিভিন্ন অসংগতি তথ্য আসার পর তিনি তদন্তের অনুমতি চান। পরে তাঁকে শুধু তিনটি তলা নিয়ে তদন্তের অনুমতি দেওয়া হয়।

অন্য কোনো যোগ্য লোক না থাকায় ওই কর্মকর্তাকে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
ইফতেখারুল ইসলাম খান, ট্রাস্টের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক

আবদুল কাইয়ুম বলেন, তদন্ত করে তিনি অনিয়ম উদ্‌ঘাটন করে কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক এক প্রতিষ্ঠানপ্রধানসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু ট্রাস্টের তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখারুল ইসলাম খান কোনো ব্যবস্থা নেননি। উল্টো অভিযুক্ত এক কর্মকর্তাকে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের দায়িত্ব দেন।

এ বিষয়ে ইফতেখারুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, অন্য কোনো যোগ্য লোক না থাকায় ওই কর্মকর্তাকে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

এদিকে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স এখন বলছে, তারা গুলিস্তান কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ শেষ করতে চায়। এ বিষয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বরাবর একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে আলোচনার পর চুক্তি করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ট্রাস্ট সূত্র জানিয়েছে, তাদের ট্রাস্টি বোর্ডের পরবর্তী সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।

গুলিস্তান কমপ্লেক্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও ট্রাস্টের কিছু অসাধু কর্মকর্তা মিলে কমপ্লেক্সকে লুটপাটের জায়গায় পরিণত করেছেন।
আবু তাহের সরকার, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের কল্যাণের জন্য। ট্রাস্টের অধীনে এখন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। অভিযোগ আছে, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ট্রাস্টের সম্পদ থেকে আয় হয় সামান্য। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে মাসে ট্রাস্টের ব্যয় গড়ে মাত্র ৪৩ লাখ টাকা।

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের সরকার প্রথম আলোকে বলেন, গুলিস্তান কমপ্লেক্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও ট্রাস্টের কিছু অসাধু কর্মকর্তা মিলে কমপ্লেক্সকে লুটপাটের জায়গায় পরিণত করেছেন। তিনি বলেন, ট্রাস্টের নিজের সক্ষমতা আছে। তারাই গুলিস্তান কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শেষ করুক। তাহলেও লাভবান হওয়া সম্ভব।