ছোট্ট শিশুটি বলল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে

ছোট হাত পৌঁছাতে পারেনি টিসিবির ট্রাক পর্যন্ত
 ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর নীলক্ষেত আবাসিক এলাকা। ভরদুপুরে টিসিবির সাশ্রয়ী পণ্যের জন্য মানুষের দীর্ঘ সারি। সবার উচ্চতা গড়পড়তা একই। এর মধ্যেই দুই পাশের মানুষের ভিড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিল সাত বছরের ছোট্ট একটি শিশু।

প্রথম শ্রেণির ছাত্রী নাদিয়া জান্নাত (ছদ্মনাম) জীবনে প্রথম টিসিবির সাশ্রয়ী পণ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিল রোববার। এতটুকু বয়সেই এমন দায়িত্ব পালনের দায় সম্পর্কে বুঝতে শেখেনি শিশুটি। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলে, জানতে চাইলে এক হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিতে নিতে বলল, ‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’

জান্নাতের এক হাতের মুঠোয় ধরা ৬১০ টাকা। আরও প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষার পর ওর পালা এলে দেখা গেল, ছোট হাত দুটো পৌঁছাচ্ছে না ট্রাক পর্যন্ত। পেছন থেকে একজন এসে বিক্রয়কর্মীর হাতে দিল ওর টাকা। বিপত্তি হলো ট্রাক থেকে পণ্য দেওয়ার পর। তেল, পেঁয়াজ, চিনি আর ডাল মিলিয়ে প্রায় ১০ কেজি ওজন। স্বাভাবিকভাবেই বুঝে নিতে সময় লাগছিল বেশি।

এত ভারী ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরবে কেমন করে, জিজ্ঞাসা করলে জান্নাত বলল, ‘কী করব, আম্মু অসুস্থ। বাজার করার এত টাকা আমার আব্বুর তো নাই।’ এতটুকু মুঠোয় অতখানি ওজন সামলানো অসম্ভব দেখে লাইন থেকে দুজন এগিয়ে এসে ব্যাগসহ ওকে তুলে দিল ফুটপাতে।

নীলক্ষেত আবাসিক এলাকায় সাশ্রয়ী পণ্যের জন্য মানুষের ভিড়

ঢাকা শহরে চৈত্রের দুপুরে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ভেতর দুই ঘণ্টা ধরে পথে দাঁড়িয়ে থাকায় ফরসা মুখটা তেতে উঠেছে জান্নাতের। ওর সঙ্গে কথা বলার সময় পেছন থেকে এগিয়ে এলেন এক নারী। তিনি জান্নাতের প্রতিবেশী। তিনি জানালেন, জান্নাতের মা সন্তানসম্ভবা। আজিমপুরে ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে ফটোকপির দোকান চালান তার বাবা। করোনার জন্য ব্যবসার অবস্থা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। গ্রামের বাড়ি গিয়েছেন জমি বিক্রি করে টাকা আনতে। তাই মা–বাবা দুজনের কেউই আসতে পারেননি টিসিবির লাইনে সাশ্রয়ী দামে পণ্য কিনতে।

এতটুকু শিশু টিসিবির পণ্য নিতে পারে কি না, জানতে চাইলে বিক্রয় প্রতিনিধিদের একজন বললেন, ১৮ বছরের ছোট হলে তাদের কাছে বিক্রি করা নিষেধ। তবে অতটুকু শিশু ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে থাকার পর তাকে আর খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।

ব্যাগসহ পথে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পরও জান্নাতের পক্ষে তখনই বাড়িতে ফেরা সম্ভব হচ্ছিল না। নারীদের সারির পেছন দিকে আছেন তার আরেক প্রতিবেশী। তাঁরই ভরসায় জান্নাতের মা মেয়েকে পাঠিয়েছেন। তিনি পণ্য পেলে ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে যাবেন তাকে। এই বাজারে কত দিন চলবে, জানতে চাইলে জান্নাত হাতের আঙুল গুণে ঠিক হিসাব করে উঠতে পারল না। দুই হাত ছড়িয়ে বলল, অনেক দিন আব্বুকে তেল কিনতে হবে না।

ক্লান্ত হয়ে ফুটপাতে বসেন কেউ কেউ

একপর্যায়ে নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার ফুটপাতে গজিয়ে ওঠা গাছের গায়ে হাত রেখে শরীরের ভারসাম্য রাখল শিশুটি। চোখেমুখে ভীষণ ক্লান্তি। তবে তেল, ডাল, পেঁয়াজ নিতে পারায় খুশি লেপ্টে আছে মুখে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে অসহায় মানুষের সীমাবদ্ধতার প্রতীক হয়ে রইল টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সাত বছরের এক ছোট্ট শিশু। দিন দিন বাড়ছে এমন সব মুখ।