চাকরি পেলেন রোজিনা

ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের লো-ভিশন বিভাগে কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করছেন মোছা. রোজিনা বেগম। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের লো-ভিশন বিভাগে কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করছেন মোছা. রোজিনা বেগম। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

‘এর আগেও বহু বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি। কিন্তু এত ভালো পরিবেশ কোথাও পাইনি। সবাই হাতে ধরে ধরে সবকিছু শিখিয়ে দিলেন। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মানুষ এত ভালো হয় তা জানাই ছিল না।’

চাকরির প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে কথাগুলো একটানা বললেন ৪২ বছর বয়সী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রোজিনা বেগম। তিনি ইস্পাহানি ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে যোগ দিয়েছেন।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি প্রথম আলো অনলাইনে ‘কেউ আমাকে একটি চাকরি দেবেন?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদন দেখে রোজিনার পাশে দাঁড়ায় ইস্পাহানি ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের সহায়তায় রোজিনা চাকরি পান। আজ শনিবার রাজধানীর ফার্মগেটে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রথম অফিস করেন রোজিনা। রোজিনা এখানে স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের কাউন্সেলিং করাবেন।

জন্মের পর আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত চোখে আলো ছিল। তারপর টাইফয়েড জ্বরে দুই চোখের আলো নিভে যায় রোজিনার।
রোজিনা রাজধানীর আগারগাঁও সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছেন। জন্ম থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ফজলে রাব্বীকে বিয়ে করেছিলেন রোজিনা। স্বামীর সঙ্গে তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে থাকতেন। গত বছরের মার্চে স্বামী হঠাৎই মারা যান। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে ফারিহা জাহান এবং পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে রাফিউন রাফিকে নিয়ে রোজিনা বিপাকে পড়েন। ঢাকায় থাকার সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও ঠাকুরগাঁওয়ে রোজিনা গানের টিউশন করতেন। তবে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার আগে, রমজানের সময় এসব টিউশন বন্ধ রাখতে হয়। টিউশন সব সময় পাওয়া যায় না। স্বামী মারা যাওয়ার পর পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়। সব মিলে খারাপ সময় পার করছিলেন রোজিনা।

হাসপাতালে রোগীদের কাউন্সেলিং করাতে হবে ব্রেইল পদ্ধতি এবং কম্পিউটারে দক্ষ রোজিনাকে। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

রোজিনার বাবা মারা গেছেন। মা চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। বড় ভাই সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। আরেক ভাই ব্যক্তিগত গাড়ির চালক।

চাকরির সুবাদে রোজিনা বর্তমানে রাজধানীর মিরপুরে বাসা ভাড়া নিয়েছেন। ছেলেমেয়ে নিয়ে সেখানে থাকছেন। জানালেন, আজ তিনি একাই বাসা থেকে এসে অফিস করেছেন এবং আবার বাসায় ফিরেছেন। কোনো সমস্যা হয়নি। তবে ছেলেমেয়েরা অনেক চিন্তা করেছে।

কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে রোজিনা বলেন, ‘আমি স্বল্প দৃষ্টি নিয়ে যে রোগীরা আসবে তাদের কাউন্সেলিং করাব। চোখে কম দেখা শুরু হলে বেশির ভাগই হতাশ হয়ে যায়। ভাবে, পরিবারে বোঝা হয়ে গেল। তাকে দিয়ে আর কিছু হবে না। আমি তাদের সামনে একজন মডেল হিসেবেই কাজ করব। তারা বুঝতে পারবে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়া মানে জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়।’

রোজিনা জানালেন, প্রথম দিন সেভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। অন্যরা কীভাবে কাউন্সেলিং করান তা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তবে পরে প্রতিদিন গড়ে ২০ জন রোগীকে কাউন্সেলিং করাতে হবে। রোজিনা ব্রেইল পদ্ধতি এবং কম্পিউটারে দক্ষ।

ইস্পাহানি ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালের উপদেষ্টা নাফিসে ইস্পাহানি টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে রোজিনাকে স্বাগত। আশা করছি তিনি ভবিষ্যতে ভালো করবেন।’

প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান কাজী মো. শরফুদ্দীন জানালেন, রোজিনা যেহেতু নিজে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, তাই তিনি যখন অন্য রোগীদের কাউন্সেলিং করাবেন, তা রোগীদের বেশি উৎসাহিত করবে। হতাশা থেকে মুক্ত হতে পারবেন। কাজী মো. শরফুদ্দীন বললেন, ‘প্রথম দিনই রোজিনা বলে দিয়েছেন, কয়েক দিন ঘোরাফেরা করলেই সব পরিচিত হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারেরা রোজিনার পক্ষে আছেন। প্রতিষ্ঠানটির সবাই রোজিনাকে সহযোগিতা করবেন।’

আরও পড়ুন
‘কেউ আমাকে একটি চাকরি দেবেন?’