পরিবহন খাতের সঙ্গে মো. রুবেল হোসেন যুক্ত সেই ১৯৯৭ সাল থেকে। শুরু থেকেই তিনি ‘পুলিশ পাস’-এর কথা শুনে আসছেন। আদৌ এ নিয়ে কোনো আইন বা নিয়ম আছে কি না, তা জানেন না তিনি। তাঁর মতো অনেক পরিবহনমালিক ও শ্রমিকের একই অবস্থা।
এত দিন শিক্ষার্থীদের জন্য বাসে অর্ধেক ভাড়ার (হাফ পাস) কথা শোনা গেলেও গণপরিবহনে ভাড়াসংক্রান্ত আরেকটি বিষয় প্রচলিত আছে। সেটিই হলো ওই ‘পুলিশ পাস’। এ ক্ষেত্রে অর্ধেক ভাড়া নয়, কোনো ভাড়াই দিচ্ছেন না অনেক পুলিশ সদস্য।
ঢাকার ভেতর চলাচলকারী স্বাধীন পরিবহনের চালক মো. রুবেল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মুখে মুখে শুনে এসেছি (পুলিশ পাসের কথা)। এটা নিয়ে কোনো আইন আছে কি না, কেউ কখনো আমাদের বলেনি। এমনকি বাসের মালিকও বলেনি।’
এ বিষয়ে বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ পাসের বিষয়ে বিআরটিএ কর্তৃক নির্ধারিত কোনো নিয়ম নেই।
কিন্তু তারপরও চলে আসছে এই অঘোষিত নিয়ম। পরিস্থান পরিবহনের একটি বাসে গত বুধবার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ চৌরাস্তা থেকে ওঠেন এক পুলিশ সদস্য। চালকের সহকারী ভাড়া চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশ পাস আছে।’ তখন তাঁর কাছ থেকে ভাড়া নেননি চালকের সহকারী। কনস্টেবল বলে পরিচয় দেওয়া সেই সদস্য নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিও তো পুলিশ পাসের কথা শুনছি। সে জন্য ভাড়া দেওয়া হয় না।’
প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাসের চালকের সহকারী মো. মনির হোসেন। শুক্রবার বছিলা বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ইউনিফর্ম থাকলে কথাই বলা যায় না। সিভিল পোশাকে থাকা অবস্থায় ভাড়া চাইলে পুলিশের পরিচয় দেয়। বেশি জোরাজুরি করলে সার্জেন্টের ভয় দেখায় কেউ কেউ।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশ ভাড়া না দিলে গ্যাঞ্জাম করবে কে? পুলিশের সঙ্গে পারব না।’
প্রজাপতি, মিডলাইন ও স্বাধীন পরিবহনের চালক–সহকারী মিলিয়ে মোট ছয়জনের সঙ্গে কথা হয়। সবাই জানান, ইউনিফর্ম পরিহিত ট্রাফিক পুলিশ বাসে খুব বেশি ওঠেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিভিল পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা পুলিশ পাসের কথা বলেন।
প্রতিবার যাওয়া-আসা মিলিয়ে ছয়টি ট্রিপ দেয় প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাস। সারা দিনে পাঁচ থেকে সাতজন পুলিশ সদস্য পুলিশ পাসের সুবিধা নেন বলে জানান মনির হোসেন।
অন্যদিকে, প্রতিদিন চারটি ট্রিপ দিতে পারে স্বাধীন পরিবহনের একটি বাস। সারা দিনে ১০ থেকে ১৫ জন পুলিশ সদস্য পাসের সুবিধা নেন বলে জানান এই বাসের চালকের সহকারী মো. হাসান।
স্বাধীন বাসের চালক মো. রুবেল হোসেন বলেন, ‘অনেক পুলিশ সদস্য হয়তো আছেন, যাঁরা পরিচয় দেন না। তাঁরা ভাড়া দেন। তবে যাঁরা কার্ড দেখান, পাসের কথা বলেন, তাঁরাই মূলত ভাড়া দেন না।’ তাঁর সহকারী মো. হাসান বলেন, ‘ভাড়া চাইলে কখনো কখনো কথাই বলেন না (কিছু পুলিশ সদস্য)। কোমরে কখনো কখনো আইডি কার্ড ঝোলানো থাকে। সেটা দেখে বুঝে নিতে হয় তিনি পুলিশ।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিকাশ পরিবহনের এক মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘(পুলিশ পাসের) বিষয়টি জানি। কিন্তু রাস্তায় সার্জেন্টের ভয় আছে। এ জন্য পুলিশ পাসের বিষয়ে কিছু বলি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আর্থিক সামর্থ্য অনেক বেশি না হলেই মানুষ গণপরিবহনে চড়ে। আর্থিক সংকট কমবেশি সবারই আছে। তাই বলে সবাইকে তো আর ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়।’
এ নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (গণমাধ্যম শাখা) উপকমিশনার ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্রাফিক সদস্যদের ডিউটি শেষ হলে (তাঁদের) একার জন্য গাড়ি নেই। সে ক্ষেত্রে গাড়িতে (গণপরিবহন) উঠলে তাঁদের ভাড়া হয়তো বিবেচনা করা হয়। বাসের চালক-সহকারীর সঙ্গে পরিচয় আছে। সে হিসেবে হয়তো ছাড় দিয়ে থাকতে পারে।...সুতরাং তাঁরা (কিছু পুলিশ সদস্য) এ ধরনের কোনো সুবিধা নিয়ে থাকলে সেটা তাঁদের ভেতর একটা পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই দীর্ঘদিনের একটা চর্চা হতে পারে।’ যেহেতু বাস কর্তৃপক্ষ কোনো অভিযোগ করে না, তাই এটা স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন বলে জানান তিনি।