দখল ও দূষণে সংকুচিত হয়ে গেছে ঢাকা উত্তর সিটির খালগুলো।
লোকমুখে খালটি ‘প্যারিস’ খাল হিসেবে পরিচিত। এর কারণ, রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীর প্যারিস রোড এলাকার ভেতর দিয়ে গেছে খালটি। তবে কাগজ-কলমে এই খালের নাম বাইশটেকী খাল। এর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ২৮০ মিটার, প্রস্থ ১২ মিটার বা প্রায় ৪০ ফুট। সিটি করপোরেশনের নথিতে খালের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের যে বর্ণনা, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই।
প্যারিস রোড এলাকায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্মাণাধীন ছয়তলা বিপণিবিতানের উল্টো পাশ থেকে প্যারিস খালের শুরু। সেখানে খালের প্রস্থ ১০ ফুটের মতো থাকলেও এরপর খালটি যতই এগিয়েছে, প্রস্থ যেন তত কমেছে। এর মধ্যে মিরপুর-১০ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকে জুটপট্টি এলাকায় খালের সীমানার ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে স্থানীয় ওয়ার্ড (ঢাকা উত্তর সিটির ৩ নম্বর ওয়ার্ড) আওয়ামী লীগের কার্যালয়। খালের তিন-চার ফুট অংশ দখল করে একতলা ভবনে কার্যালয়টি করা হয়েছে। এই জায়গায় খালটি এখন মৃতপ্রায়। এই জায়গাকে ‘ডেড স্পট’ বা মৃতপ্রায় স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
খালের জায়গা দখল করে দলীয় কার্যালয় তৈরি করার বিষয়ে ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কার্যালয় ভবনের দু-তিন ফুট খালের সীমানার মধ্যে পড়েছে, এটি ঠিক। তবে খাল সংস্কারের কাজ শুরু হলে ওই অংশ ভেঙে ফেলা হবে।
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের উল্টো পাশে খালের সীমানার ওপর আধা পাকা একটি ঘর তুলে বিরিয়ানি বেচাকেনা হয়। এরপর আরেকটু এগোলে সামনে খালের অবস্থা আরও করুণ। খাল হয়ে গেছে পয়োনালা। খালের এক পাশ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দ্বিতল ভবন, যা এখন পোশাক কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই কারখানার পাশে খালের প্রস্থ পাঁচ ফুটের কম। খালের এই অংশকেও ‘ডেড স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিভিন্ন খালের মৃতপ্রায় জায়গাগুলোর কিছু পরিষ্কার করা হয়েছে, কিছু জায়গায় কাজ চলমান আছে। যেখানে সুযোগ ছিল সেখানে খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) ব্যবহার করে খনন ও পরিষ্কার দুটোই করা হয়েছে। আর যেখানে পাড়ে জায়গা ছিল না, সেখানে শুধু কর্মীদের দিয়ে পরিষ্কার করানো হয়েছে।এস এম শরীফ-উল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর
প্যারিস খাল দখল ও সংস্কার না করায় প্রতি বর্ষায় ভারী বৃষ্টি হলে মিরপুরের একটি অংশে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে আড়াই লাখ মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়।
প্যারিস রোড এলাকা থেকে শুরু হওয়া এই খাল মিরপুরের বাইশটেকীর পলাশনগর হয়ে মিরপুরেরই বাউনিয়া খালে গিয়ে মিশেছে। এই খালে ডেড স্পট রয়েছে মোট দুটি। খাল বাঁচাতে হলে ওই ডেড স্পট দূর করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই বলে মনে করেন ডিএনসিসির কর্মকর্তারা।
প্যারিস খালের মতোই ডিএনসিসির আওতাধীন ২৯টি খাল ও ১টি জলাধার দখল ও দূষণের কারণে সংকুচিত হয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৯টি খাল ও ১টি জলাধারের ৪২টি জায়গা ডেড স্পট গত ফেব্রুয়ারি মাসে চিহ্নিত করেছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ওই সব স্থানে দূষণ, দখল কিংবা ভরাটের কারণে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২৯টি খাল ও ১টি জলাধারের সীমানা চিহ্নিতকরণ ও খুঁটি স্থাপনের কাজ শুরু করেছে।
ডেড স্পট হিসেবে চিহ্নিত ৪২টি স্থানের (১৯টি খালে) মধ্যে ৩৬টি স্থান (১৩টি খালে) গত মার্চ মাসে সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। একই স্থানগুলো চলতি জুন মাসের ২ ও ৩ তারিখ আবার ঘুরে দেখেছেন তিনি। ১৩টি খালের জায়গায় দেখা গেছে রাজনৈতিক কার্যালয়, বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন, বস্তিঘর, শৌচাগার এবং চায়ের দোকান—ছয় ধরনের অবৈধ স্থাপনা। এসবের ফল হচ্ছে, খালের সরু হয়ে কোথাও নালা হয়ে গেছে।
খালের পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার কিছু জায়গায় ময়লা-আবর্জনা ও বালু-মাটি জমে খালের গভীরতা কমেছে। এ ছাড়া খালে ফেলা হচ্ছে আবর্জনা ও পুরোনো আসবাব। বিভিন্ন খালের ওপর করা বক্স কালভার্টের নিচে সেগুলো জমাটবদ্ধ হয়ে আটকে থাকছে। আবার কোথাও কোথাও খালে বাঁশ-কাঠ পুঁতে ও সিমেন্টের বস্তা ফেলে রাস্তা তৈরি করায় পানি চলার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এস এম শরীফ-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন খালের মৃতপ্রায় জায়গাগুলোর কিছু পরিষ্কার করা হয়েছে, কিছু জায়গায় কাজ চলমান আছে। যেখানে সুযোগ ছিল সেখানে খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) ব্যবহার করে খনন ও পরিষ্কার দুটোই করা হয়েছে। আর যেখানে পাড়ে জায়গা ছিল না, সেখানে শুধু কর্মীদের দিয়ে পরিষ্কার করানো হয়েছে।
খালের পানিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা ও লেকের পানি দূষণমুক্ত রাখতে তাঁরা নতুন একটি প্রকল্প নেওয়ার কথা ভাবছেন। তখন সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বিষয়টি সুরাহা করা হবে।হাফিজুল ইসলাম, রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পের পরিচালক
দখল হয়ে যাওয়া খালের জায়গা উদ্ধারের বিষয়ে এস এম শরীফ-উল ইসলাম বলেন, একটি প্রকল্পের আওতায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে খালের সীমানা চিহ্নিতকরণ ও খুঁটি স্থাপনের কাজ চলছে। সীমানা চিহ্নিত হয়ে গেলে খালের জায়গা উদ্ধার করতে বড় পরিসরে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।
উত্তরা এলাকার আবদুল্লাহপুর খালটি স্থানীয়ভাবে ‘খিজির খাল’ নামে পরিচিত। এই খাল দিয়েই উত্তরার বিভিন্ন সেক্টর, তুরাগ ও হরিরামপুর এলাকার পানি নিষ্কাশিত হয়। সিটি করপোরেশন এই খালের উত্তরা-১০ নম্বর থেকে উত্তরা-১২ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত চারটি অংশকে মৃতপ্রায় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। করপোরেশন বলছে, খালের ওই অংশের পানিপ্রবাহের পথ বন্ধ করে সেখানে কৃত্রিম লেক তৈরি করেছে রাজউক। এর ফলে ওই এলাকায় ভারী বৃষ্টি হলে পানি সরতে পারে না। জলাবদ্ধতার ভোগান্তিতে পড়েন তুরাগ ও হরিরামপুর এলাকার কিছু অংশের মানুষ।
সিটি করপোরেশন বলছে, যখন সেখানে লেক করা হয়, তখন খালের দায়িত্বে ছিল ঢাকা ওয়াসা। সিটি করপোরেশনের অধীনে খাল আসার পর খালের পানিপ্রবাহ আটকে দেওয়ার বিষয়টি রাজউককে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পের পরিচালক হাফিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খালের পানিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা ও লেকের পানি দূষণমুক্ত রাখতে তাঁরা নতুন একটি প্রকল্প নেওয়ার কথা ভাবছেন। তখন সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বিষয়টি সুরাহা করা হবে।
শুরুতে খাল নিয়ে সিটি করপোরেশনের যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল, তা এখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেছে। খাল নিয়ে সিটি করপোরেশনের মনোযোগ আরও বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকায় খাল নিয়ে বেশ কিছু সমীক্ষা করেছে উত্তর সিটি করপোরেশন।মোহাম্মদ ফজলে রেজা, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি
মিরপুরের টোলারবাগ ও দক্ষিণ বিশিল এলাকার গোদাগাড়ী খালের নাম কাগজপত্রে ‘কল্যাণপুর (খ) খাল’। খালের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৪০৮ মিটার। এর প্রস্থ ২৪ থেকে ৩৬ ফুট। কিন্তু বাস্তবে খালের বেশির ভাগ অংশের প্রস্থ ১০ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১৫ ফুট।
মিরপুর শাহ আলী মাজারের উল্টো পাশ থেকে খালের শুরু। এরপর গাবতলী হয়ে কল্যাণপুর জলাধারে মিশেছে খালটি। এর মধ্যে দক্ষিণ বিশিল থেকে টোলারবাগের ২০/১৪ বি খালি প্লট পর্যন্ত এই খালের ওপর কোনো বক্স কালভার্ট নেই। সরেজমিনে দেখা গেছে, খালের এই অংশের এক পাশে বস্তিঘর, অন্য পাশে টোলারবাগ এলাকার সীমানাদেয়াল। এখানে খালের প্রস্থ সর্বোচ্চ ১০ ফুট।
কল্যাণপুর (চ) খালেরও একই অবস্থা। কাগজ-কলমে এই খালের দৈর্ঘ্য ৯৮২ মিটার, প্রস্থে ৯-২৪ মিটার। খালের শুরু জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) পেছন থেকে। এরপর শ্যামলী হয়ে কল্যাণপুর মূল খাল হয়ে কল্যাণপুর জলাধারে মিশেছে। এর মধ্যে পঙ্গু হাসপাতালের পেছনে খালের জায়গায় নিজের ব্যক্তিগত কার্যালয় বানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের অধীন শেরেবাংলা নগর (শিশু ও পঙ্গু) ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল বারেক। আবার শেরেবাংলা নগরের পুরোনো কাজি অফিস এলাকায় খালের ওপর তৈরি করা হয়েছে ২৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের কার্যালয়।
খালের জায়গায় কার্যালয় তৈরির বিষয়ে আবদুল বারেকের কার্যালয়ে গতকাল শুক্রবার বিকেলে যান এই প্রতিবেদক। তখন কার্যালয় বন্ধ ছিল। এর আগে তাঁর বক্তব্য নিতে গত মার্চ মাসেও সেখানে যান এই প্রতিবেদক। সেদিনও কার্যালয় বন্ধ ছিল।
কল্যাণপুর (চ) খালের একটি অংশের (বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ভবনের পেছনে) দুই দিকেই সারি সারি বস্তিঘর। এর মধ্যে কিছু বস্তিঘর খালের পাড়ে আর কিছু খালের সীমানার ভেতরে।
ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আগে ছিল ঢাকা ওয়াসার। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সেই দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করে ওয়াসা। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির অধীনে যায় ২৯টি খাল, আর ঢাকা দক্ষিণের কাছে যায় ৬টি খাল।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে খাল নিয়ে সিটি করপোরেশনের যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল, তা এখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেছে। খাল নিয়ে সিটি করপোরেশনের মনোযোগ আরও বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকায় খাল নিয়ে বেশ কিছু সমীক্ষা করেছে উত্তর সিটি করপোরেশন। কিন্তু সমীক্ষায় কী পাওয়া গেল, কারা খাল দখল করে আছে, সেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এগুলো দ্রুত প্রকাশ করতে হবে এবং খাল দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।