তিন জলাধার ও খাল খনন

কোটি টাকা খরচেও মৃতপ্রায়

সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান ছাড়া কাজ করার অভিযোগ। বিলের প্রায় ২৪ শতাংশ কেটে রাখার সুপারিশ থাকলেও মানা হয়নি।

জলাধারের চর জেগে আছে। গত বুধবার রাজধানীর কল্যাণপুর পাম্প হাউস এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর একটি জলাধার ও দুটি খাল খননে প্রায় কোটি ব্যয় করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। কিন্তু গভীরতায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে জলাধার ও খালের যে ৪২টি স্থানকে মৃতপ্রায় বা ‘ডেড স্পট’ হিসেবে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত করেছে, সেই তালিকাতে ঠাঁই হয়েছে দুটি খাল ও জলাধারটির।

ডিএনসিসির কর্মকর্তারা বলেন, সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান ছাড়া তড়িঘড়ি করে কাজ করার কারণে এমন দশা হয়েছে। সেখানে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক করতে চাইলে আবারও খননকাজ চালাতে হবে।

ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ গত বছরের ৩০ মে ক্রিয়েশন ট্রেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দুটি ভাসমান এক্সকাভেটর (খননযন্ত্র) ভাড়া নেওয়ার কার্যাদেশ দেয়। কাজের চুক্তিমূল্য ছিল ৯১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। দুটি ভাসমান এক্সকাভেটরের মধ্যে একটি কল্যাণপুর পাম্প হাউসের সামনের জলাধারে, অন্যটি মিরপুরের বাউনিয়া ও সাগুফতা খালের খনন ও পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত করা হয়।

তবে সিটি করপোরেশন থেকে কাজের বিষয়ে ঠিকাদারের কর্মীদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। কর্মকর্তাদের এমন গাফিলতির সুযোগে ঠিকাদারের কর্মপরিকল্পনা জমা দেওয়ার নির্দেশ থাকলেও সেটা দেননি। এ ছাড়া চুক্তিতে প্রতিটি ভাসমান খননযন্ত্রের দৈনিক ৮ ঘণ্টা ও মোট ৬০ দিন কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু যন্ত্রগুলোকে বেশিরভাগ সময় বসিয়ে রাখা হয়েছিল। এসব অনিয়ম নিয়ে গত বছরের ২৩ আগস্ট ‘কর্মপরিকল্পনা ছাড়াই খাল খননের কাজ’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন ছাপা হয়।

গত বুধবার বেলা ১১টার দিকে কল্যাণপুর পাম্প হাউসে গিয়ে দেখা যায়, জলাধারের বেশির ভাগ জায়গা শুকনা। যেখানে থাকার কথা পানি, সেখানে চর জেগে আছে। খননকাজের ফলে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তনের চিহ্নও নেই। জলাধারের দক্ষিণ অংশে ছোট খালের মতো করে পানি যাচ্ছে পাম্প হাউস পর্যন্ত।

মিরপুর ১২ নম্বর এলাকার সাগুফতা খাল ও মিরপুর ১৪ নম্বর এলাকায় বাউনিয়া খালেও কাগজকলমে খননকাজ হয়েছিল। বাউনিয়া খালপাড়ের একাধিক বাসিন্দা বলেন, দিনে পানির প্রবাহ বেশি থাকায় খালের চর বোঝা যায় না। রাতে যখন মানুষের পানির ব্যবহার কিছুটা কমে আসে, তখন চর দেখা যায়।

খালপাড়ের বাসিন্দা ইব্রাহিম খলিল প্রথম আলোকে বলেন, ভাসমান খননযন্ত্র দিয়ে যখন কাজটি করা হয়েছিল, তখন বর্জ্য ও বালুমাটি খালপাড়ে ফেলা হয়। কিছু জায়গায় মাটি খুঁড়ে তা আবার খালেই ফেলা হয়।

সাগুফতা খালের কালশী স্টিলের সেতুর উত্তর পাশে খালটি মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই অংশে গত বছরে তারা কোনো ভাসমান খননযন্ত্রকে কাজ করতে দেখেননি।

ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, খননকাজে অনিয়মের সত্যতা পাওয়ায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বিলের প্রায় ২৪ শতাংশ কেটে রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল।
কিন্তু শাস্তির বদলে ঠিকাদারকে প্রায় পুরো টাকা দেওয়া হয়েছে। শুধু কিছু সময় কাজ হয়নি ধরে নিয়ে ওই সময়ের জ্বালানি তেল বাবদ লাখখানেক টাকা কাটা হয়েছে।

ডিএনসিসির আরেক কর্মকর্তা বলেন, জলাধার শুকনো। কোনো কাজই যে হয়নি, এটা তার প্রমাণ। কারণ, একটি এক্সকাভেটর দিয়ে টানা দুই মাস ওই স্থানে খননকাজ করা হয়েছে, অথচ দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন নেই। অন্যদিকে খনন করা মাটি ও বালু জলাধারেই ফেলা হয়েছিল। কারণ, মাটি ও বর্জ্য পাড়ে নিতে ব্যবহৃত লোহার তৈরি ড্রামে কাজ শুরুর কিছুদিন পরেই ছিদ্র তৈরি হয়। এ ছাড়া তখন জলাধারে পানির উচ্চতা বেশি থাকায় ভাসমান অবস্থায় মাটি পাওয়া যাচ্ছে না বলেও জানিয়েছিলেন ঠিকাদারের নিয়োজিত কর্মীরাই।

‘তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তাই কী হয়েছিল বলতে পারব না।’
এম শরিফ উল ইসলাম, ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর

এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এম শরিফ উল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তাই কী হয়েছিল বলতে পারব না।’ তবে কল্যাণপুর পাম্প হাউস এলাকার জলাধার খননে ভাসমান খননযন্ত্র নামানো হয়েছিল উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই স্থানে গিয়ে দেখলাম, ভাসমান খননযন্ত্র ব্যবহার করলে সময়ের অপচয় হবে। কারণ, ওই যন্ত্রটিকে (ভাসমান এক্সকাভেটর) একবার মাটি তুলেই সেই মাটি রাখতে পাড়ে যেতে হবে। এতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। বিপরীতে খননযন্ত্রের জন্য ঘণ্টাপ্রতি টাকা দিতে হবে। এ জন্য পরের দিনই যন্ত্রটি সরিয়ে ফেলা হয়।’

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন ট্রেডের মালিক তোহরাব আলীর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।