ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘তেঁতুলতলা মাঠে থানা না এলাকাবাসীকে হয়রানি ও আটকের তীব্র প্রতিবাদ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন করেন অধিকারকর্মীরা
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘তেঁতুলতলা মাঠে থানা না এলাকাবাসীকে হয়রানি ও আটকের তীব্র প্রতিবাদ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন করেন অধিকারকর্মীরা

কী নিয়ে আন্দোলন করা যাবে না, তার তালিকা দেওয়া হোক

রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রত্নাকে ১৩ ঘণ্টা আটকে রাখার ঘটনার সমালোচনা করেছেন অধিকারকর্মীরা। অভিযোগ ছাড়া নাগরিককে তুলে নিয়ে যাওয়া কেন, সরকারি কাজে বাধা দেওয়া কী, অভিযোগ ছাড়া এক নারীকে তুলে নেওয়া, গণতান্ত্রিক দেশে আন্দোলন না করার মুচলেকা কেন—এসব প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। তেঁতুলতলা মাঠে থানা না বানানোর দাবি জানিয়ে তাঁরা রত্নাকে আটকের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান।

আজ সোমবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘তেঁতুলতলা মাঠে থানা না এলাকাবাসীকে হয়রানি ও আটকের তীব্র প্রতিবাদ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে অধিকারকর্মীরা এসব কথা জানান। সংবাদ সম্মেলনের আয়োজক ছিল এএলআরডি, বাপা, বেলা, আসক, ব্লাস্ট, গ্রীন ভয়েস, নিজেরা করি, নাগরিক উদ্যোগ, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি ও টিআইবি।

খেলার মাঠ রক্ষার জন্য প্রতিবাদে নেমেছিলেন মা। সে কারণে মায়ের সঙ্গে তাঁর কিশোর ছেলেকে আটক করে দিনভর রাখা হয় থানাহাজতে। রোববার রাজধানীর কলাবাগান থানায়। (কিশোরটির মুখ অস্পষ্ট করে দেওয়া হলো)।

রাজধানীর পান্থপথের উল্টো দিকের গলির পাশের খোলা জায়গাটিই তেঁতুলতলা মাঠ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় শিশুরা সেখানে খেলাধুলা করে। পাশাপাশি মাঠটিতে ঈদের নামাজ, জানাজাসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান হয়। এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে খেলতে যাওয়া কয়েকটি শিশুকে কান ধরে ওঠবস করায় পুলিশ। এর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।

সম্প্রতি মাঠটি কলাবাগান থানা ভবন করার জন্য তাদের বরাদ্দ দেয় ঢাকা জেলা প্রশাসন। কিন্তু এই মাঠ খেলার জায়গা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজের রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দা রত্না। তিনি উদীচীরও সদস্য। গতকাল রোববার থানা ভবন নির্মাণের প্রতিবাদ করায় এবং নির্মাণকাজের ভিডিও ধারণ করায় বেলা ১১টার দিকে সৈয়দা রত্নাকে আটক করে পুলিশ। পরে তাঁর ছেলেকেও ধরে নেওয়া হয়। পরে বিক্ষোভের মুখে মাঝরাতে তাঁদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এ মাঠ রক্ষায় এবং রত্নাকে বিনা অভিযোগ আটক রাখার প্রতিবাদ জানিয়েছে একাধিক সংগঠন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গতকাল দিনভর কলাবাগান থানা কর্মকর্তাদের মুঠোফোন বন্ধ ছিল। কেউ কোনো উত্তর দিচ্ছিলেন না। যাঁরা থানায় খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের প্রথম ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় বলেও জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে গেলে এখন হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। বসবাসের অযোগ্যের তালিকায় থাকা শহরে একটা খেলার মাঠ নিয়ে নেওয়া মানে আত্মহত্যার শামিল। এলাকাবাসী খেলবে কোথায়, এই জবাব কি কর্তৃপক্ষ দেবে?

রত্নাকে আটকের ঘটনা প্রসঙ্গে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আবার দেখলাম। তিনি যদি কোনো আইন ভঙ্গ করতেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু পুলিশ চাইলে তার গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে পারে এবং তাঁর ছেলেকেও তুলে নিয়ে গেল।’

গতকালের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তাঁরা আইনি ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া বলেন, ‘মুচলেকার ভাষা হচ্ছে মাঠ রক্ষার আন্দোলন করা যাবে না। আমরা বলি গণতন্ত্র, আবার বলি মাঠ রক্ষার আন্দোলন করা যাবে না। তাহলে কী নিয়ে আন্দোলন করা যাবে, তার একটা তালিকা দিয়ে দেওয়া হোক। সরকারি কাজের তালিকা দেওয়া হোক।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুজন নাগরিককে আটকে রাখা যায়। কিন্তু এ দেশে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি কোনো দিন হবে না? বলবে না তারা লজ্জিত বা দুঃখিত। সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আটক করে একটি মুচলেকা দিয়ে ছাড়া হয়েছে। এটি পরিকল্পিত। এলাকার অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য।’

নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, ‘এটা কি মগের মুল্লুক নাকি যে চেনা মুখ হলেই রেহাই পাওয়া যেতে পারে? এই দেশে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার নাই? আইন কি নিজের মতো চলে না?’

রত্নাকে ছেড়ে দেওয়ার পরও সংবাদ সম্মেলন করার কারণ হিসেবে খুশী কবির বলেন, মানুষ প্রশ্ন করবে, জবাব চাইবে। নাগরিককের কী অধিকার, সুরক্ষার জন্য কী ব্যবস্থা—এসব কথা বলতে হবে।

জনগণের বন্ধু বলা হয় পুলিশকে। তারা যদি বন্ধুই হয়ে থাকে, তাহলে তারাই সবার আগে মাঠ রক্ষায় এগিয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন। শহরের মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধানমন্ডির শেখ জামাল মাঠটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষ ঢুকতে পারে না। সেখানে পুলিশ কোথায়, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘তেঁতুলতলা মাঠে থানা না এলাকাবাসীকে হয়রানি ও আটকের তীব্র প্রতিবাদ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন করেন অধিকারকর্মীরা

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, তেঁতুলতলা মাঠটি সংরক্ষণ করতে হবে এবং থানা নির্মাণের কাজ দ্রুত বন্ধ করতে হবে। মাঠটি রক্ষায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও রাজউককে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। পাশাপাশি সৈয়দা রত্না, তাঁর পরিবার এবং আন্দোলনে যুক্ত এলাকাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া তিনি বলেন, গতকালের ঘটনায় ১০টি আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। শিশু অধিকার রক্ষার কথা বলায় মাকে জেলে দিতে হবে? এই অবিচারের বিচারের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানান। তেঁতুলতলা মাঠ থেকে দ্রুত কাঁটাতারের বেড়া সরানোর দাবি জানিয়ে বলেন, প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সহসভাপতি মাহমুদ সেলিম, সহসাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন, ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিমসহ প্রমুখ।