রাজধানীর মধ্য বাসাবোর বাসিন্দা মো. সেলিম মিয়া বাসায় ঢুকতে কয়েক দিন গ্যাসের গন্ধ পাচ্ছিলেন। তবে তেমন আমলে নেননি। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণে (৪ সেপ্টেম্বর) মুসল্লিরা মারা যাওয়ার পর তিনি সতর্ক হন। গত সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় তিতাস গ্যাস অফিসে যোগাযোগ করেন।
তিতাস অফিস সেলিম মিয়াকে জানায়, এই মুহূর্তে তাদের জরুরি সেবা দেওয়ার টিম নেই। রাতে পাঠানো হবে। এদিকে সেলিম মিয়া মধ্য বাসাবোর যে ভবনে থাকেন, সে ভবন ও তার চারপাশের ভবনের মানুষের উৎকণ্ঠা শেষ হয় না। চুলা জ্বালানো বন্ধ। অবশেষে সোমবারই রাত নয়টার দিকে তিতাসের একটি দল এল ঘটনাস্থলে। বিষয়টি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে জানাল, পাইপ লিকেজ বা ছিদ্র থাকায় গ্যাস বের হচ্ছে। কিন্তু এটি তারা সারতে পারবে না।
এবার সেলিম মিয়া আরও বিপাকে পড়লেন। তিতাসের লোকজন জানালেন, মাটির ওপর একটি অংশ থাকে, যা রাইজার নামে পরিচিত—এ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হলে তা মেরামত করে দেয় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। কিন্তু রাইজারের পরে যদি ছিদ্রসহ কোনো ধরনের ত্রুটি দেখা দেয়, তাহলে তা ওই গ্রাহকের নিজের দায়িত্বে মেরামত করে নিতে হয়। সেলিম মিয়া যে ভবনে থাকেন, সেখানকার গ্যাস পাইপলাইনে যে ছিদ্র হয়েছে, তা রাইজারের পরে, ফলে এটি তাদের তত্ত্বাবধানেই মেরামত করতে হবে। অবশ্য তিতাস গ্যাসের লোকজন যাওয়ার আগে রাইজার বন্ধ করে গ্যাস–সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দিলেন, যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। পরে সেলিম মিয়ারা ওই গ্যাসলাইন নিজেদের তত্ত্বাবধানে ঠিক করে নিয়েছেন।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের ১২টি জেলায় গ্যাস বিতরণ করে থাকে। এই ১২ জেলায় তিতাসের প্রায় সাড়ে ২৮ লাখ গ্রাহক রয়েছে। এসব গ্রাহকের বড় অংশই জানেন না পাইপলাইন বা গ্যাস ব্যবহারের কোনো সমস্যা দেখা দিলে কী করতে হবে, কোথায় ফোন দিতে হবে। এ নিয়ে তিতাস গ্যাসেরও বড় রকম কোনো প্রচার প্রচারণাও নেই।
তিতাস গ্যাস ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলায় গ্যাস সরবরাহ করছে।
দেশের পাইপলাইনে যে গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তা নাকে গেলে হালকা গন্ধ পাওয়া যায়। পাইপলাইন ছিদ্র হওয়া ছাড়াও গ্যাস নানাভাবে বের হয়ে আসতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো নিম্নমানের চুলা ও চুলায় ব্যবহৃত প্লাস্টিকের পাইপ থেকে গ্যাস বের হয়ে থাকে।
তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা বলছেন, কোথাও গ্যাস বের হলে বাতাসে গন্ধ পাওয়া যায়। তবে সেটি তীব্র নয়। অনেকে এটি বুঝতেও পারেন না। পাইপলাইন ছিদ্র হয়ে গ্যাস বের হলে সেখানে যদি পানি থাকে তাহলে বুদবুদ দেখা যায়। এভাবেও বোঝা যায় গ্যাস বাইরে চলে আসছে। এ ছাড়া অনেক স্থানে নির্মাণকাজ করতে গিয়েও পাইপলাইন ছিদ্র করে ফেলে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বড় আকারে গ্যাস বাইরে এলে শোঁ শোঁ শব্দ হয়। কিন্তু ছোট আকারে ছিদ্র হলে গ্যাস যে পরিমাণ বের হয়, তা অনেক সময় বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এ ধরনের কোনো চিহ্ন ও গন্ধ পেলে সঙ্গে সঙ্গে তিতাসের হটলাইনে কল করা উচিত গ্রাহকের। তাঁদের বক্তব্য হটলাইনটি দিনরাত সব সময় খোলা থাকে।
তিতাস গ্যাস কোম্পানি এলাকায় যেকোনো তথ্য অনুসন্ধান বা অভিযোগের জন্য ১৬৪৯৬ এই হটলাইন নম্বরে কল করা যাবে। এই নম্বরটিতে কল করলে রাত–দিন ২৪ ঘণ্টার যেকোনো সময় সেবা পাওয়া যাবে। ঢাকার জন্য জরুরি সেবা দিতে ২৪টি ‘ইমার্জেন্সি’ টিম রাখা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মসজিদে দুর্ঘটনার পর সাম্প্রতিক সময় তিতাসের হটলাইন নম্বরে কল দেওয়ার হার বেড়ে গেছে। প্রতিদিন এখন গড়ে ৩০০ কল আসছে খোদ রাজধানী এলাকায়।
এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. আল-মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের একটি কেন্দ্রীয় হটলাইন নম্বর আছে, যেখানে কল করলে দিন–রাতের যেকোনো সময় সেবা পাওয়া যায়। এ ছাড়া আঞ্চলিক অফিসগুলোর পৃথক নম্বরও রয়েছে। এসব তথ্য আমাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে। এ ছাড়া গ্রাহকের সুবিধার্থে আমরা আরও বড় রকম প্রচার–প্রচারণায় যাওয়ার কথা ভাবছি।’
১৯৬৪ সালে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড আত্মপ্রকাশ করে। প্রথমে শিল্প–কারখানায় সংযোগ দিলেও রাজধানীতে ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের বাসায় গ্যাস–সংযোগ দিয়ে আবাসিক খাতে সংযোগ শুরু হয়। তিতাস গ্যাসের অনেক এলাকার লাইনের বয়স ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। জীর্ণ এসব পাইপলাইনের মাধ্যমে ঢাকার বহু এলাকায় গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। তিতাস কর্মকর্তারা ঠিকমতো বলতেও পারেন না মাটির কত নিচে এবং কোথায় পাইপলাইন রয়েছে। ফলে প্রায় বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ঢাকা ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়নকাজ করতে গিয়ে মাটির নিচের পাইপলাইন ছিদ্র করে ফেলছে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তিতাস ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে তিতাস উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব (ডিপিপি) পেট্রোবাংলায় জমাও দিয়েছে। এ প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে ঢাকায় ডিজিটাল মানচিত্র তৈরি হবে তিতাসের। এ ছাড়া ১২৩টি স্থান থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এসব স্থানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানা যাবে কোথায় গ্যাসের কতটুকু চাপ রয়েছে, পাইপলাইনের অবস্থার খোঁজও জানা যাবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২ থেকে ২০ ইঞ্চি পুরোনো পাইপলাইনের পরিবর্তে নতুন পাইপলাইন স্থাপন করা হবে।
এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. আল-মামুন বলেন, ইতিমধ্যে প্রকল্পটির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন। পেট্রোবাংলায় ডিপিপি জমা পড়েছে। দ্রুতই এটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এ প্রকল্পটি শেষ হলে তিতাসের পাইপলাইন ও গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তি যুক্ত হবে। সেবা আরও সহজ হবে।