বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চাকুরে দিলশাদ বেগম এসেছেন বৈশাখী মেলায়। বাঁশের তৈরি মাছ পরিষ্কার করার একটি বিশেষ ধরনের পাত্র কিনেছেন। তাঁদের গ্রামে এটিকে বলে ‘ডুলা’। তিনি বললেন ‘এতে ঘষে নিলে মাছের আঁশ ভালোভাবে পরিষ্কার হয়। মেলায় বিক্রি হচ্ছে দেখেই কিনে নিয়েছি। দাম নিল ৮০ টাকা।’
গত সোমবার বিকেলে দেখা গেল, দিলশাদ বেগমের মতো আরও অনেকেই বাংলা একাডেমির মাঠে বৈশাখী মেলায় ঘুরে গ্রাম–বাংলার ঐতিহ্যবাহী শৌখিন ও ঘরসংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী কিনছেন। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ থেকে এখানে শুরু হয়েছে ১০ দিনের বৈশাখী মেলা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) নকশা কেন্দ্র আয়োজিত এই মেলা চলবে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা। সকাল থেকে শুরু হলেও মেলা জমতে শুরু করে বিকেলে। সন্ধ্যার পর থেকে মেলা জমজমাট হয়ে ওঠে। এ সময় বটলার মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন থাকে। বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত শিল্পীরা এখানে গান পরিবেশন করেন।
বৈশাখী মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হস্ত, কুটির কারুশিল্পী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রায় ২০০টি স্টল রয়েছে। একই সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের ‘আড়ং’। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইগুলো এখানে ২৫ শতাংশ ছাড়ে বিক্রি করা হচ্ছে। মেলা চলাকালীন একই সময়সূচিতে চলবে এই বইয়ের আড়ং।
বিসিকের মহাব্যবস্থাপক শাহ নুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৮ সাল থেকে বিসিক এই মেলার আয়োজন করছে। আগে নগরীর বিভিন্ন স্থানে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমির মাঠেই মেলা হচ্ছে। সারা দেশ থেকে আসা কারুশিল্পীরা এই মেলায় অংশ নেন। তাঁরা তাঁদের পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রির সুযোগ পান। এভাবেই কারুশিল্পের বিকাশে বিসিকের এই মেলা ভূমিকা রাখছে।
বাংলা একাডেমির পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্রের সামনে আমতলার বেদিতে চারদিকে গোল করে বাঁশের তৈরি কুলা, বিভিন্ন আকৃতির চালুনি, খলুই, ছোট-বড় ঝুড়ি, খোঁপার ক্লিপ, হাতপাখা তৈরি ও বিক্রি করছে দুই কারুশিল্পী পরিবার। জানা গেল, তারা এসেছে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী থেকে। এ ছাড়া একই সঙ্গে আছে বাঁশের বাঁশি, গয়না ও হরেক রকম সামগ্রী।
বিসিকের এই মেলায় ঠাকুরগাঁও থেকে আসা সৈয়দ ফিরোজ মোরশেদ শতরঞ্জি, কাপড়ের ব্যাগ, মাদুরের স্টল নিয়ে অংশ নিয়েছেন। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের বিভিন্ন বিভাগের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছেন নিজেদের হাতে তৈরি মৃৎশিল্পী, কাপড়ের ওপর করা কাজের গয়না ও শাড়ির সম্ভার নিয়ে। চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের জাফরুন নাহার আরও ছয়জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি স্টল দিয়েছেন।
বৈশাখী মেলায় আছে বিভিন্ন দামের তাঁতের কাপড়, জামদানি শাড়ি, পাট ও চামড়ার তৈরি ব্যাগ, জুতা, সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি, ঘর সাজানোর পুতুল, বাঁশের পণ্য, মৃৎশিল্প, শখের হাঁড়ি, পটচিত্র, সোলার পণ্য, পিতলের গয়না, কাঠের শিল্প, পাটপণ্য, নকশিকাঁথা, মুখোশ, বিছানার চাদর, কুশন কভার, ল্যাম্প, শতরঞ্জি, গয়না, রকমারি চুড়ি, পুঁতির মালা, ঝিনুকের পণ্য। এবার মেলায় অংশ নিয়েছে বেতের তৈরি আসবারের দোকান। এখানে সোফা, চেয়ার, দোলনা, টেবিল ল্যাম্প, বুকশেলফ ও রকিং চেয়ার পাওয়া যাচ্ছে। এসবের সঙ্গে আছে ঐতিহ্যবাহী কদমা-বাতাসা, মন্ডা-মিঠাই, মুরালি, মোয়া-মুড়ি, খই, মধু, নানান রকমের আচার আর মুখরোচক খাবারের দোকান।
মেয়ের স্কুল ছুটির পর মেলায় এসেছেন সাবরিনা রুবেল। তিনি জানালেন, প্রতিবছরই আসেন। এই মেলায় তাঁর সবচেয়ে পছন্দ বিভিন্ন স্টলের হাতের কাজের পোশাক।
একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনে একটানা ১০টি স্টলে কারুশিল্পীগণ তাঁদের বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন। সেখানে আছে শখের হাঁড়ি, সোলার তৈরি ফুল, চেইন, মাথার টোপর, পাখা। আছে তামা ও পিতলের ওপর নকশা ফুটিয়ে তোলার কাজের সরঞ্জাম। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে আসা সন্ধ্যা রানী ও আরতি সূত্রধর কাপড়ের ওপর রঙিন সুতার নকশা করা পাখা তৈরি করছেন। ছোট পাখাগুলো বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ আর বড়গুলো ১০০ টাকায়।
মেহেদি লাগানোর ব্যবস্থাও আছে মেলায়। আর ২০ টাকায় দেখা যাবে জলিল মণ্ডলের বায়োস্কোপ। মাঠের পশ্চিম অংশে শিশুদের জন্য মিনি ট্রেন ও নাগরদোলা আর পুতুলনাচের মঞ্চ। সব মিলিয়ে সময়টি বেশ কেটে যাবে মেলায় এলে।