মগবাজারে বিস্ফোরণ

কারও যেন দায় নেই, ক্ষতিপূরণ পাওয়াটাও দুরাশা

মগবাজারে বিস্ফোরণে ধ্বসে পড়ে ভবনটি।
 ছবি: প্রথম আলো

মগবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় ভবনমালিকসহ তিতাস গ্যাস, বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানির ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ, সিটি করপোরেশনের অপরিকল্পিত খননকে সন্দেহের তালিকায় রেখে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশ। কিন্তু ঘটনার আট দিন পার হলেও এ ঘটনার জন্য দায়ী কেউই গ্রেপ্তার হয়নি। এমনকি এ ঘটনায় নিহত ১১ জনের পরিবারের কেউ পায়নি ক্ষতিপূরণও।

মগবাজারের রাখী ভিলায় বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পক্ষ থেকেও তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু কেউই প্রতিবেদন দেয়নি।

ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দিনমণি শর্মা গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও করোনায় চলমান কঠোর বিধিনিষেধের কারণে সব কাজ শেষ করা যায়নি। তবে খুব শিগগির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হতে পারে। একই ধরনের কথা বলেন বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদও। তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিস্ফোরণটি জমে থাকা গ্যাস থেকে ঘটেছে বলে মনে করছেন তিনি।

তবে মামলা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের ডিসি সাজ্জাদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে। তবে তদন্তে কোনো অগ্রগতি না থাকায় মামলার তদন্তভার পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটে হস্তান্তর হয়েছে।

গত ২৭ জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মগবাজারের রাখী ভিলা নামের পুরোনো তিনতলা ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে আশপাশের সাতটি ভবনের গ্লাস ভেঙে চুরমার হয়। আহত হন দুই শতাধিক ব্যক্তি। মারা গেছেন ১১ জন।

একের পর এক বিস্ফোরণ, মৃত্যু

মগবাজারের রাখী ভিলায় বিস্ফোরণের ১০ মাস আগে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের তল্লা এলাকার একটি মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ৩৪ জন মারা যান। তিতাস গ্যাসের ছিদ্র থেকে ওই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৭৩ জন। কিন্তু এ ঘটনায় করা ফৌজদারি মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। জানা যায়নি আগুনের উৎসও।

মগবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনার ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক এবং সেফটি ম্যানেজমেন্ট ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, মগবাজারের বিস্ফোরণের পর তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেছেন, সেখানে পুরোনো লাইন ছিল। জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তিতাস গ্যাসের এসব সংযোগ দেখভাল করার কেউ নেই। পরিদর্শনও করা হয় না। অভিযোগ দিলেও সেভাবে কেউ আসে না। এ দুর্ঘটনার জন্য তিতাসকে দায়ভার নিতে হবে। সেখানে সুয়ারেজ লাইন ছিল। এর আগেও নারায়ণগঞ্জের একটি মসজিদেও একই ঘটনা ঘটেছে।

অবশ্য মগবাজারের রাখী ভিলায় তিতাস গ্যাসের সংযোগ ছিল না দাবি করে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, মগবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় তিতাসের কোনো দায় নেই। কারণ, সেখানে তিতাস গ্যাসের কোনো সংযোগ ছিল না।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত বছর দেশে গ্যাসলাইন এবং গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৯৫৭টি। অগ্নিদুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৫৪ জন। অগ্নিকাণ্ড ছাড়া সড়ক, নৌ, রেল, ভবন, ভূমিধস, বজ্রপাত, গ্যাস সিলন্ডারসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ২০৮ জন।

আর ২০১৯ সালে গ্যাস, এলপিজি গ্যাস ও সিলিন্ডার গ্যাস থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮১৮টি। মারা গেছেন ২৫ জন। বিভিন্ন ধরনের অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন ১৮৪ জন। ফায়ার সার্ভিসের বার্ষিক পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে অগ্নিকাণ্ডসহ নানা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৬ হাজার ১৫৬ জন।

ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে জরিপ চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান। তিনি বলেন, প্রায়ই গ্যাস থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনা কমাতে ঢাকা মহানগরসহ অন্যান্য নগর-মহানগরে বড় ধরনের জরিপ চালানো দরকার। ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যদি তথ্য থাকে, কতগুলো ভবনের গ্যাসসংযোগ ঝুঁকিপূর্ণ, তাহলে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। কর্তৃপক্ষের কাছে যদি তথ্যই না থাকে, তাহলে কিছুদিন পরপর এমন দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

ক্ষতিপূরণ পায় না পরিবার

মগবাজারের রাখী ভিলা ভবনে চার বছর ধরে নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন হারুনর রশীদ হাওলাদার। বিস্ফোরণের ঘটনার এক দিন পর তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। হারুন ছাড়া আরও ১০ জন মারা গেছেন। ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা বলছেন, একটি টাকাও তাঁরা ক্ষতিপূরণ পাননি।

কেবল ঢাকা জেলা পরিষদ লাশ দাফনের জন্য কয়েকটি পরিবারকে অর্থসহায়তা দিয়েছে।

হারুনর রশীদ হাওলাদারের মেয়ে হেনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মা থাকেন গাজীপুরে। বাবা রাখী ভিলা ভবনে চাকরি করে যে টাকা পেতেন, সেই টাকায় সংসার চলত। বাবা মারা যাওয়ায় এখন মা কীভাবে চলবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। বাবা মারা গেলেও একটি টাকাও ক্ষতিপূরণ দেয়নি কেউ।’

কেবল হারুনর রশীদ হাওলাদার নন, অধিকাংশ দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না।

অবশ্য আইনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার চাইলে ক্ষতিপূরণ চেয়ে নিম্ন আদালতে মামলা করতে পারেন। তবে হাতে গোনা দু–একটি পরিবার ছাড়া বেশির ভাগ ভুক্তভোগী পরিবার মামলা করে না।

সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মগবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবি রাখেন। পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যাপারে আইনি সহায়তা দেওয়া উচিত।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনও প্রথম আলোকে বলেন, মগবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত পরিবারের সদস্যরা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারেন।
মগবাজারের বিস্ফোরণে ঘটনায় হতাহত পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনি সহায়তা দিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক চেয়ারপারসন ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না প্রস্তুত বলে প্রথম আলোকে জানান। তিনি বলেন, এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লেগে যায়। বিলম্বিত বিচার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা।