কর্মপরিকল্পনা ছাড়াই খাল খননের কাজ

কার্যাদেশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কাজ নিয়ে কর্মপরিকল্পনা দিতে বলা হলেও দুই ঠিকাদারের কেউই তা দেননি

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম

১ কোটি ৮২ লাখ ৭২ হাজার টাকায় ৪টি ভাসমান খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) ভাড়া নিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। উদ্দেশ্য ছিল জরুরি ভিত্তিতে খাল খনন ও পরিষ্কার করার মাধ্যমে বর্ষা মৌসুমে রাজধানী ঢাকায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসন করা।

তবে এই কাজে খনন–সংক্রান্ত সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা করপোরেশন ঠিকাদারদের দেয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কর্মকর্তাদের গাফিলতির সুযোগে ঠিকাদারেরাও মানেননি কার্যাদেশের নির্দেশনা। কার্যাদেশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কাজ নিয়ে কর্মপরিকল্পনা দিতে বলা হলেও দুই ঠিকাদারের কেউই তা দেননি।

এই কাজ দিয়েই যেখানে ঢাকা শহরের পানি ১২ ঘণ্টার বেশি জমা থাকত, সেটা তিন ঘণ্টায় নামিয়ে আনতে পেরেছি। সুতরাং কাজ যে হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
আতিকুল ইসলাম মেয়র, ডিএনসিসি

ফলে আদতে কোন খালে কী পরিমাণ কাজ হয়েছে, কিংবা কোন খাল থেকে কী পরিমাণ বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে, এ–সংক্রান্ত সঠিক কোনো হিসাব উভয় পক্ষের কারও কাছে নেই। চুক্তি অনুযায়ী ভাড়ায় আনা প্রতিটি এক্সকাভেটরের দিনে ৮ ঘণ্টা করে ৬০ দিন কাজ করার কথা থাকলেও সরেজমিন বেশির ভাগ সময় এক্সকাভেটরগুলো বসিয়ে রাখতে দেখা গেছে।

এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এম সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষায় খালের কিছু জায়গায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। তাই তাৎক্ষণিকভাবে চারটি এক্সকাভেটর ভাড়া নিয়ে কাজে নামানো হয়েছে। মূলত খালের যে যে জায়গায় সমস্যা ছিল, ওই জায়গাগুলোতে কাজ করা হয়েছে।

এই কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন ট্রেড ও মেসার্স জোহরা এন্টারপ্রাইজ ২টি করে ৪টি খননযন্ত্র সরবরাহ করেছে। চুক্তি অনুযায়ী একেকটি এক্সকাভেটরের দৈনিক ভাড়া আসে ৭৬ হাজার টাকা।

বর্জ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ক্রিয়েশন ট্রেডের দুটি এক্সকাভেটরের একটি কল্যাণপুর পাম্পহাউসের জলাধার খনন ও পরিষ্কারের কাজ করেছে। অন্যটি প্রথমে মিরপুর-১২–এর সাগুফতা খালে, পরবর্তী সময়ে মিরপুর-১৪ নম্বরের বাউনিয়া খালে কাজ করে। আর জোহরা এন্টারপ্রাইজের একটি এক্সকাভেটর মিরপুরের দ্বিগুণ খালে, অন্যটি খিলক্ষেতের বরুয়া খালে কাজ করেছে।

ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই কাজ দিয়েই যেখানে ঢাকা শহরের পানি ১২ ঘণ্টার বেশি জমা থাকত, সেটা তিন ঘণ্টায় নামিয়ে আনতে পেরেছি। সুতরাং কাজ যে হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই ৩ ঘণ্টার সময়ের বেশি ঢাকা শহরের কোথাও পানি জমে থাকেনি, এটাই অর্জন। তা ছাড়া কী কী কাজ করতে হবে, এই বিষয়গুলো ঠিকাদারকে আগেই বলে চুক্তি করা হয়। ঠিকাদার তা অনুসরণ করেন। কাজ না হলে ঠিকাদারকে কাজের বিল দেওয়া হবে না।’

৬০ দিনের কাজ ৩২ দিনে শেষ

টানা কয়েক দিন সরেজমিন পরিদর্শন করে কল্যাণপুর পাম্পহাউসের জলাধারে নিয়োজিত এক্সকাভেটরটি বসিয়ে রাখতে দেখা গেছে। ৬ আগস্ট বেলা আড়াইটায় এক্সকাভেটর চালাতে দেখা যায়নি। সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাম্পহাউসে চলে আসেন চালক মো. বাপ্পী। দ্রুত এক্সকাভেটর চালু করে তা নিয়ে জলাধারের মধ্যে চলে যান। এরপরে আরও দুদিন (আগস্টের ৭ তারিখ বেলা ১১টায় ও ৮ আগস্ট বেলা ৩টায়) গিয়েও এক্সকাভেটর দিয়ে কাজ করতে দেখা যায়নি। সূত্র জানায়, ওই দুদিন সকালে কিছুক্ষণ চালানোর পরেই কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

কল্যাণপুরে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ও অপারেটরদের (খননযন্ত্রের চালক) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৯ জুন থেকে কল্যাণপুর জলাধারে কাজ শুরু করা হয়। মাঝে জুলাইয়ের ১৮ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত মোট ১২ দিন ঈদের ছুটি ছিল। এরপরে জুলাইয়ের ৩০ তারিখ থেকে আগস্টের ১১ তারিখ পর্যন্ত কাজ করা হয়। অপারেটরদের দেওয়া এই হিসাব অনুযায়ী, কল্যাণপুর জলাধারে খননের কাজ হয়েছে মাত্র ৩২ দিন। চুক্তি অনুসারে যেখানে সর্বমোট ৬০ কর্মদিবস কাজ করার কথা ছিল।

কল্যাণপুর জলাধারে অপারেটর আজহার আলী বলেন, ‘পানি অনেক বেশি, তলা পাই না। কাজ করতে হবে, তাই যেভাবে পেরেছি, কাজ চালিয়ে গেছি। কিন্তু কত গভীর করতে হবে, কিছুই বলে দেয়নি।’ তিনি বলেন, এই কাজ যদি অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে করা হতো, তাহলে ঠিকমতো কাজ করা যেত।

মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকার বাউনিয়া খালে আরেকটি খননযন্ত্র কাজ করছিল। খাল থেকে তোলা বালু-মাটিও খালের দুই পাড়েই ফেলতে দেখা যায়।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জোহরা এন্টারপ্রাইজের সরবরাহ করা এক্সকাভেটর দুটির একটি খিলক্ষেতের বড়ুয়া খাল খনন ও পরিষ্কারের কাজ করেছে। ১৬ আগস্ট সেখানে গিয়ে এক্সকাভেটর পাওয়া যায়নি।

এই ঠিকাদারের অন্য একটি এক্সকাভেটর দ্বিগুণ খালে কাজ করেছে। যে খাল দিয়ে মিরপুর এলাকার বৃষ্টির পানি গোড়ান চটবাড়িতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জলাধারে নিষ্কাশিত হয়। ডিএনসিসির কর্মকর্তারা বলছেন, খালের শেষ প্রান্তে প্রচুর আবর্জনা ছিল। ফলে পানিনিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এখন জায়গাটি পরিষ্কার করা হয়েছে।

কর্মপরিকল্পনা ছাড়াই কাজ

ঠিকাদারের প্রতিনিধিরা বলছেন, কোনো কর্মপরিকল্পনা ছিল না। তাঁদের শুধু খনন করতে ও ময়লা পরিষ্কার করতে বলা হয়েছে। কোথায় কতটুকু গভীর করতে হবে, এ নিয়ে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।

করপোরেশনের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কার্যাদেশে নির্দেশনা থাকলেও ঠিকাদারেরা কোনো কর্মপরিকল্পনা জমা দেননি। কর্মপরিকল্পনা দেওয়া হলে তা ওই কাজের নথিপত্রে থাকত। তবে নথিতে কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই।

ঠিকাদারদের একজন প্রতিনিধি কর্মপরিকল্পনা জমা না দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। ওই প্রতিনিধি বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী অসুস্থ থাকায় কর্মপরিকল্পনা দেওয়া হয়নি।

এই কাজের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করি সিটি করপোরেশন ওয়াসার মতো লোকদেখানো কাজ করবে না। কারণ, মানুষ সমাধান চায়। খালের সঠিক সীমানা নির্ধারণসহ সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে জনগণের পয়সা আর পানিতে যাবে না।’